কিছুদিন আগেই চলে গেল বিশ্ব জলাভূমি দিবস। খবরের কাগজে ইস্ট কলকাতা ওয়েটল্যান্ড নিয়ে অসংখ্য লেখালিখি বেরোলো এবং সময়ের সাথে সাথে তা মানুষের নজর থেকে উধাও হয়ে গেল। জলাভূমি এক অদ্ভুত সুন্দর ইকোসিস্টেম বা বাস্তুতন্ত্র যা জল মাটি এবং জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। জলাভূমি গুলি জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে যেরকম বিপন্ন ঠিক তেমনই জলাভূমি সংরক্ষণ না করা গেলে জলবায়ু পরিবর্তন আরো বিপদজনক হয়ে যেতে পারে।
পৃথিবীর স্থলভাগের মাত্র ৫ থেকে ৮ শতাংশে জলাভূমি থাকলেও বৈজ্ঞানিকদের অনুমান এটি প্রায় কুড়ি থেকে ত্রিশ শতাংশ কার্বন কে নিজের মধ্যে ধরে রেখেছে। অর্থাৎ জলাভূমি গ্রীন হাউজ গ্যাস বাতাস থেকে অপসারণের অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।
জলাভূমি থেকে মিথেন গ্যাস যা আগুন ধরে গেলে ছোটবেলায় আমরা আলেয়ার আলো বলতাম। মিথেন গ্যাস বেরোনোর জন্য অনেকক্ষেত্রেই জলাভূমিকে গ্রিনহাউস গ্যাসের উৎস রূপে চিহ্নিত করা হয়। কিন্তু বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানে এটা প্রমাণিত যে জলাভূমি নিজে যতটা পরিমাণ কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করে মাটিতে সঞ্চয় করে, তা জলাভূমি থেকে নির্গত মিথেন এর তুলনায় অনেক অনেক গুণ বেশি। কাজেই জলাভূমিকে আমরা গ্রিনহাউস গ্যাসের সিঙ্ক হিসেবে চিহ্নিত করি এবং জলাভূমি নষ্ট হলে গ্লোবাল ওয়ার্মিং বা ক্লাইমেট চেঞ্জ বাড়বে বৈ কমবে না।
সম্প্রতি এক বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান দেখিয়েছে যে জলাভূমি সবমিলিয়ে বছরে প্রায় ০.৮৩ মিলিয়ন টন কার্বন শোষণ করে নিজের মধ্যে রাখতে পারে যা প্লেন এবং জাহাজ থেকে নির্গত কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণের সমান।
ইস্ট কলকাতা ওয়েটল্যান্ড বা পূর্ব কলকাতা জলাভূমির কথা যদি আমরা বলি, তাহলে আমরা দেখতে পাবো যে প্রতিদিন এই জলাভূমিতে প্রায় ১০০০ মিলিয়ন লিটার (১ মিলিয়ন মানে ১০ লক্ষ) নোংরা জল বিভিন্ন নালার মাধ্যমে এসে পড়ে, পরিশুদ্ধ হয় এবং তিন থেকে চার সপ্তাহ বাদে তা বঙ্গোপসাগরে মিশে যায়। কলকাতায় উৎপাদন হওয়া নোংরা জলের 80 শতাংশ বেশি ইস্ট কলকাতা ওয়েটলান্ড পরিশুদ্ধ করে। যদি আমাদের কৃত্রিম উপায়ে ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট প্লান্ট করে এই জলপরী শুদ্ধ করতে হতো তাহলে বছরে ৫০০ কোটি টাকার কাছাকাছি খরচা হত। কিছুদিন আগে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের বৈজ্ঞানিক দের দ্বারা একটি অনুসন্ধানে জানা গেছে যে ১৯৭২ সাল থেকে ২০১১ সাল এই ৪০ বছরের মধ্যে প্রায় ৪০ বর্গ কিলোমিটার অঞ্চল জলাভূমি থেকে শহরে পরিণত হয়েছে।
শুধুমাত্র জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো বা নোংরা জল পরিষ্কার করাই নয়, জলাভূমি মাত্রই জৈব বৈচিত্রের আখড়া। অসংখ্য উদ্ভিদ, পাখি, মাছ এবং স্তন্যপায়ী প্রাণীদের আশ্রয়স্থল জলাভূমি। শহরে অতিবৃষ্টি হলে বন্যায় আটকাতে জলাভূমির জুড়ি মেলা ভার আবার এই জলাভূমি শহরের বাতাসকে পরিশুদ্ধ করতে সাহায্য করে।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে জলাভূমিতে বসবাস কারী অসংখ্য প্রাণী এবং উদ্ভিদ অতিরিক্ত তাপ, অতিবৃষ্টি, বন্যা, পোকামাকড়ের আক্রমণ বৃদ্ধি এবং সাইক্লোন ইত্যাদি দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছে। এর সাথে আছে জলাভূমির ওপরে বাড়ি বানানো, চাষবাস, জঞ্জাল ফেলা ইত্যাদি অসংখ্য কার্যকলাপ যা জলাভূমিকে ধীরে ধীরে নষ্ট করে দিচ্ছে। শুধুমাত্র ইস্ট কলকাতা ওয়েটল্যান্ড অন্ততপক্ষে ২০ হাজার মানুষ তার জীবিকা অর্জন করে মাছ চাষ বা সবজি চাষের মাধ্যমে। ইস্ট কলকাতা ওয়েটল্যান্ড ছাড়াও দিনাজপুরের রায়গঞ্জের কুলিক জলাভূমি, সুন্দরবন, মুর্শিদাবাদের আহিরণ বিল বা চাঁদ বিল, কোচবিহারের রসিকবিল উল্লেখযোগ্য। এই প্রসঙ্গে বলে দেওয়া ভালো পশ্চিমবঙ্গে ইস্ট কলকাতা ওয়েটলান্ড নিয়ে যতটা মাতামাতি হয় তার ১% বোধহয় মাতামাতি হয় না বাকি জলাভূমিগুলি কে নিয়ে। জেলা ভিত্তিক জলাভূমিগুলির কোন লিস্ট কিন্তু সঠিকভাবে পাওয়া যায় না। জুওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া ১৯৯৯ সালের এক রিপোর্ট অনুযায়ী শুধুমাত্র হাওড়া এবং হুগলি জেলায় প্রায় ৩২ খানা জলাভূমির উল্লেখ আছে। কাজেই বাড়ির কাছের জলাভূমি গুলি কে চিহ্নিত করুন এবং করে গুগল ম্যাপে তুলে ধরুন, যাতে পরবর্তী কালে বোঝা যায় যে সেই জলাভূমিগুলি ধ্বংসের দিকে যাচ্ছে কি যাচ্ছে না। শেষ করব এক আরও বৃহত্তর সংকটের কথা বলে। জলাভূমি শুধুমাত্র গ্রিন হাউস গ্যাসের স্থল হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ নয় তার সাথে জড়িয়ে আছে মানুষ, প্রকৃতি, প্রাণী এবং উদ্ভিদ জগৎ। অথচ ভারতবর্ষের মতো একটি দেশে যেখানে জলাভূমির ছড়াছড়ি সেখানে জলাভূমি সংরক্ষণ নিয়ে সরকারি পদক্ষেপ বিরল। অনেক জলাভূমি সংরক্ষণের অভাবে এবং মানুষের আনুকূল্যে ধ্বংসের মুখে। পরিকল্পিতভাবে নষ্ট করা হচ্ছে বিপুল কার্বনের ভান্ডারগুলিকে। ফলে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর প্রাকৃতিক প্রতিরোধের পথগুলিও আস্তে আস্তে বন্ধ হচ্ছে।