প্রতিবেদন

নেট জিরো জলবায়ু পরিবর্তনের একটি বড় ফাঁদ

নেট জিরো জলবায়ু পরিবর্তনের একটি বড় ফাঁদ

ইউনিভার্সিটি অফ এক্সটার, ইউনিভার্সিটি অফ ইস্ট আংলিয়া এবং লুন্ড ইউনিভার্সিটির তিন বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক জেমস ডাইক, রবার্ট ওয়াটসন এবং উলফগাং নর বিখ্যাত কন্সারভেসান পত্রিকার জন্যে একটি প্রবন্ধ লেখেন। সেখানে তারা নেট জিরো পলিসির দীর্ঘসুত্রীতা এবং কেন এই পদ্ধতি কার্যকরী হবে না সেই নিয়ে লেখেন। তার সারসংক্ষেপ বঙ্গানুবাদ করল সবুজ পৃথিবী।

১৯৮৮ সালের জুনের ২২ তারিখে জেমস হ্যানসেন নাসার একজন সাধারন অ্যাডমিনিস্ট্রেটর ছিলেন যাকে ইউনিভার্সিটির বাইরে খুব একটা মানুষ চিনত না। সেই জেমস হ্যানসেন ২৩ শে জুন রাতারাতি বিশ্বের সবথেকে বিখ্যাত জলবায়ু বৈজ্ঞানিক হয়ে গেলেন। এর কারণ তার যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেসে পেশ করা একটি তথ্যাবলী যা জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে এবং তার মূল কারণ যে মানুষের কর্মকান্ড সেই বিষয়ে আলোকপাত করে। আমরা যদি সেই সময় বিজ্ঞানী হ্যানসেনের কথা অনুযায়ী চলে পৃথিবীতে কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গমন এর বিভিন্ন রাস্তা গুলিকে আস্তে আস্তে বন্ধ করতে শুরু করতাম তাহলে হয়তো জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে এত আন্দোলনের দরকার হতো না।

যাই হোক তারপরে এসেছে রিও আর্থ সামিট যেখানে পৃথিবীর প্রায় সবকটি দেশই গ্রীন হাউজ গ্যাসের কন্সেন্ট্রেশন কে বাগে আনার কথা বলেছেন। তারপরে এল কি এত সামিট যেখানে কথা হল কম গ্রীন হাউজ গ্যাস নির্গমন করার পদ্ধতিটি কে আমাদের অভ্যাসের মধ্যে আনতে হবে। কিন্তু এত কথার মধ্যে আসল কাজটা অর্থাৎ কিনা গ্রীন হাউজ গ্যাস নির্গমনের হার কমাবার প্রক্রিয়া শুরু হচ্ছিল না। দীর্ঘসূত্রিতা ক্রমশ বাড়তে থাকে। ইতিমধ্যে বাড়তে থাকা গ্রিন হাউস গ্যাস ভবিষ্যতের পৃথিবীতে কিভাবে প্রভাব ফেলবে তা নিয়ে কম্পিউটার মডেল তৈরি হয়েছে। এই মডেল গুলিতে গ্রিন হাউস গ্যাসের প্রভাব কমাবার বিভিন্ন পদ্ধতি দেশগুলির অর্থনীতিতে কিভাবে প্রভাব ফেলবে তা নিয়ে অংক কষে ভবিষ্যৎ নির্মাণের চেষ্টা করা হয়েছে।
কিন্তু মুশকিল হল কম্পিউটারে অংক কষে পলিসি বলা এবং তাকে সরাসরি ইমপ্লিমেন্ট করে সেই অংক মিলিয়ে দেওয়ার মধ্যে অনেকটা ফাঁক আছে। এই মডেলগুলি আমাদের চিন্তাভাবনাকে সাংঘাতিক ভাবে প্রভাবিত করল। এই মডেলগুলি এমন একটি সমাজ ব্যবস্থার কথা বলে যেখানে মানুষ প্রায় রোবটের মত আচরণ করে এবং আমাদের সমাজ রাজনীতি ও অর্থনীতির যে জটিল সম্পর্ক আছে সেই সম্পর্ক গুলিকে তুলে ধরার কোন চেষ্টা এই মডেল গুলিতে ছিলনা। অর্থাৎ এই মডেলগুলি ভবিষ্যতের পৃথিবীর তাপমাত্রা বা বৃষ্টিপাত কেমন হবে তা সম্পর্কে প্রায় নিখুঁত ভবিষ্যৎবাণী করতে পারলেও, ঠিক কি পলিসি নিলে ভবিষ্যতে অর্থনীতি কি রকম হবে সেই সংক্রান্ত পূর্বাভাস সঠিকভাবে করতে সক্ষম ছিল না।
এই সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মতামত রাখে যে যদি আমরা দেশের বনাঞ্চল গুলি কে ঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারি তাহলে সেটি ভবিষ্যতে অনেক পরিমাণে কার্বন বাতাস থেকে শোষণ করবে এবং যেহেতু তা ভবিষ্যতে কার্বন শোষণ করবে তাই আমরা এখন জীবাশ্ম জ্বালানি পুড়িয়ে কার্বন বের করলেও অসুবিধা হবে না। কম্পিউটার মডেল গুলিতে অর্থনীতির সাথে সাথে এই গাছের কার্বন শোষণ করার ক্ষমতা ঢোকানোর অজুহাতে আমরা আসলে বর্তমান সময়ে যতখুশি কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ করার ছাড়পত্র পেয়ে গেলাম।

যাই হোক এরকম ভাবে বেশ চলছিল, নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি থেকে উন্নত দেশগুলিতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে কয়লা বিহীন পদ্ধতিগুলি কে প্রাধান্য দেওয়ার প্রচেষ্টা শুরু হয়। আশা করা হচ্ছিল যে নিউক্লিয়ার বা প্রাকৃতিক গ্যাসের থেকে প্রাপ্ত বিদ্যুৎ ক্রমাগত বেড়ে যাওয়া গ্রিন হাউস গ্যাসের হারকে কমাতে পারে। বিংশ শতকের গোড়ার দিকে পরিষ্কার বোঝা গেল না, সে আশা বৃথা। তখন অর্থনীতি এবং জলবায়ুর মডেলগুলি আস্তে আস্তে কার্বন ক্যাপচার এবং স্টোরেজ নামের একটি বিশেষ টেকনোলজিকে ভবিষ্যতের আশা বলে অংক কষতে শুরু করে।
নীতিগতভাবে বিভিন্ন বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বেরোনো কার্বন-ডাই-অক্সাইডকে আলাদা করে তাকে ভূপৃষ্ঠের অভ্যন্তরে ঢুকিয়ে দেওয়া সম্ভব। বিশ্বের কিছু কিছু জায়গায় পরীক্ষামুলকভাবে এই কার্বন-ডাই-অক্সাইড কে কাজে লাগিয়ে তৈল ও উত্তোলন করা সম্ভবপর হয়েছে। কিন্তু ওই একটি বা দু’টি জায়গায় ছোট মাপের পরীক্ষা করা এবং বিশ্বের অসংখ্য তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের খোলনলচে পাল্টে কার্বন-ডাই-অক্সাইড আলাদা করার মধ্যে একটা আকাশ-পাতাল তফাৎ রয়েছে।

২০০৯ সালে কোপেনহেগেনে এটা পরিষ্কার হয়ে গেছিল যে কার্বন ক্যাপচার এবং স্টোরেজ ভবিষ্যতের আশার আলো দেখাতে অক্ষম। কারন এরকম কোনো কার্বন ক্যাপচার এবং স্টোরেজ পদ্ধতি সফলভাবে বড় আকারের বিদ্যুৎকেন্দ্রে আসেনি। এবং এটিকে সফলভাবে ইমপ্লিমেন্ট করতে যে পরিমাণ টাকা লাগবে তা অপরিসীম। কয়লা পুড়িয়ে তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র করার মূল উদ্দেশ্য ছিল সস্তায় বিদ্যুৎ উৎপাদন করা। সেখানে যদি কার্বন ক্যাপচার এবং স্টোরেজ পদ্ধতি ব্যবহার করা হয় সে ক্ষেত্রে বিপুল পরিমাণ খরচা হবে।
কার্বন ক্যাপচার এবং স্টোরেজ পদ্ধতির বাস্তবে কার্যকারিতা শূন্য বুঝে, বায়ো এনার্জি কার্বন ক্যাপচার এন্ড স্টোরেজ নামের এক নতুন টেকনোলজির কথা বলা হয় যেখানে কয়লার বদলে ফসল এবং ফসলের অবশিষ্টাংশ অর্থাৎ খড় পুড়িয়ে ভবিষ্যতের বিদ্যুৎ তৈরি হবে। থিওরিটিক্যালি নিখুঁত এই পদ্ধতি নিয়ে শুরু হলো প্যারিস ক্লাইমেট কনফারেন্স।

অংকের হিসেবে যদি দেখা যায় তাহলে এই খড়কুটো থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রির কম রাখতে হলে প্রতিবছর এই পদ্ধতিতে ১২ মিলিয়ন টন কার্বন ডাই অক্সাইড কমাতে হবে। বায়ু এনেরজি ক্যাপচার এন্ড স্টুডেন্ট এই পদ্ধতি অনুযায়ী মানুষকে কল কারখানার মত গাছের কারখানা বানাতে হবে যেখান থেকে তারা প্রতি বছর অন্তর প্রচুর পরিমাণে গাছ কেটে সেখান থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারে। সফলভাবে এই পদ্ধতি বাস্তবায়ন করতে গেলে পৃথিবীর সমস্ত দেশে ২৫ থেকে ৮০ শতাংশ জমিতে গাছ লাগিয়ে এই পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে। আবার যে সে গাছ হলে হবেনা সবথেকে উপযোগী হলো আখ এবং পাম যা থেকে বায়ো ডিজেল এবং বায়োইথানল তৈরি হয়। অর্থাৎ আপনি কল্পনা করুন ৮ থেকে ১০ বিলিয়ন মানুষের মধ্যে পৃথিবীর বেশিরভাগ অঞ্চলজুড়ে আখ এবং পাম গাছের সারি!!

গাছের কারখানা করে সেখান থেকে বিদ্যুৎ তৈরির স্বপ্ন অলীক মনে করে অনেকেই অবশ্য সরাসরি বাতাস থেকে কার্বন-ডাই-অক্সাইড শুষে নেওয়ার যন্ত্র তৈরির কথা বলছেন। পরীক্ষামূলকভাবে সেই যন্ত্র তৈরি হয়েছে এবং তার যে পরিমাণ খরচ এবং তাকে চালাতে যতটা পরিমাণ বিদ্যুৎ লাগছে সেটা মোটেও পোষাবে না আমাদের। কেউ কেউ আবার বলছেন বাতাসে প্রচুর পরিমাণে এরোসল পাঠিয়ে সূর্য রশ্মির প্রবেশ আটকে পৃথিবীর ঠান্ডা করার কথা। প্রচুর পরিমাণে খরচা করা হচ্ছে এই ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা তে।

পরিশেষে অংক মিলিয়ে নেট শূন্য করার পলিসি কখনোই পৃথিবীর তাপমাত্রা দেড় ডিগ্রীর নিচে আটকাতে পারবেনা। কাজেই আমাদের এবারে পরীক্ষামূলক প্রকল্প থেকে বেরিয়ে বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়ে চিন্তাভাবনা করার সময় এসেছে ।

আরো পড়ুন

সাইকেল এবং জলবায়ু পরিবর্তন

বাঁধ ভাঙ্গার গল্প

Leave a Comment