প্রতিবেদন

কার্বন ফুটপ্রিন্ট কি আসলে স্ক্যাম? মনোজ দাজুর গল্প

কার্বন ফুটপ্রিন্ট কি আসলে স্ক্যাম মনোজ দাজুর গল্প

সবে বিকেল হয়েছে। অস্তমিত সূর্যের আলো কাঞ্চনজঙ্ঘাতে পড়ে এক অসাধারণ দৃশ্যের সৃষ্টি করেছে। দেবকুমার বাবু কিছুক্ষন আগেই কচি ছাগলের মাংস কিনে এনেছেন। মনোজ দাজু ঢুকতেই দেবকুমার বাবু হাক পাড়লেন, দুটো চা দিয়ে যারে দীপেন! দীপেন টুকটাক ইলেকট্রিকের কাজ করে শিলিগুড়িতে, কদিন আছে দেবকুমার বাবুর বাড়িতে।

মনোজ দৃশ্যতই ক্ষুব্ধ, ঢুকতে ঢুকতে বলেই ফেলল; “কাজটা কি আপনি ঠিক করলেন, শেষমেশ শিলিগুড়ি থেকে ছাগল আনিয়ে কাটলেন। জানেন এর জন্যে কতটা কার্বন পুড়ল! আপনি এক কেজি ছাগলের মাংস প্রায় ১১কিমি গাড়ি চালাবার সমান কার্বন উৎপাদন করে।”

মনোজ দাজু এখন প্রায় নিরামিষাশী হয়ে গেছে। বাড়িতে সবজি করছে, মুরগি পুসছে। বাইরের খাবার খায় না বললেই হয়। সাথে সাথে আবার গরম জলে স্নান করে না এমন কি গ্রাম থেকে দেবকুমার বাবুর বাড়ি হেঁটেই চলে আসে। মাঝে মাঝেই পকেট থেকে মোবাইল বের করে অ্যাপ থেকে দেখে নেয় আজ কতটা কার্বন ফুটপ্রিন্ট হল।

দেবকুমার বাবু মনোজের রাগ অভিমান ভরা মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আহা চটিস না, কথা শোন আমার। গল্প আছে। মাথা ঠাণ্ডা করে বস। বলছি!” দীপেন ইতিমধ্যে চা নিয়ে একেবারে আড্ডার ভঙ্গিতে বসে পড়েছে। চামঙ্গের চায়ে চুমুক দিয়ে দেবকুমার বাবু বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ভাবছিলেন এই ভাবে চা আর লাল পাহাড়ের সন্ধে দিয়ে ভালোয় ভালোয় জীবনটা কেটে গেলে বাঁচি!

মনোজের গলা খাকরানি শুনে দেবকুমার বাবু একটু নড়ে চড়ে বসলেন। মনোজ আর দীপেন চা নিয়ে বসে পড়েছে। দেবকুমার বাবু শুরু করলেন; ” সত্তরের দশক বুঝলি, আমি তখন সদ্য কলেজ পাস করেছি। আমেরিকার টিভিতে একটা বিজ্ঞাপন এলো। এক জঞ্জাল ভর্তি ব্যাগ এক আমেরিকান রাস্তায় যেতে যেতে এক রেড ইন্ডিয়ানদের সামনে ফেলে দেয়। সেই জঞ্জাল দেখে রেড ইন্ডিয়ান ভদ্রলোক কেঁদে ফেলেন। ট্যাগ লাইন হল আমরাই দূষণ শুরু করি, আর আমরাই শেষ করতে পারি। সেই সময় এই বিজ্ঞাপন প্রাইজ টাইজ ও পেয়েছিল।” এক চুমুক চা খেয়ে দেব কুমার বাবু আবার শুরু করলেন; “কিন্তু ওই বিজ্ঞাপন বানিয়েছিল একটা আমেরিকান এনজিও আর তাদের ফান্ডিং দিত মার্কিন নরম পানীয় বা কোল্ড ড্রিংকস বহুজাতিক!”

“আরে তাতে কি হয়েছে, কথাটা কি ভুল!” মনোজ বলে উঠলো।

“দেখ মনোজ, তোদের এখন একটা কথা শুরু হয়েছে না যে আপ ক্রনলজি সমঝিয়ে! এবার বাপু তুই ক্রণলজি বোঝ! ২০০০ সাল, বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম তৈল কোম্পানি ব্রিটিশ পেট্রোলিয়াম একটা বিজ্ঞাপন বানালো, যে খানে দেখানো হলো বায়ু দূষণ আসলে আমাদের জন্যে হচ্ছে। আমরা আমাদের কাঠ কয়লা পড়ানো কমালেই বায়ু দূষণ কমবে! বার বার তেল আর খনির মালিকরা আমাদের বিজ্ঞাপন দিয়ে বুঝিয়েছে বাতাসে এত এত গ্রীন হাউস গ্যাস বৃদ্ধিতে তাদের কোন হাত নেই, আমরা আমাদের কার্বন ফুটপ্রিন্ট কমালেই হবে!”

একসাথে গলা ফুলিয়ে এত কথা বলে দেব কুমার বাবু একটু ক্লান্ত হয়ে পড়লেন। সেই সুযোগে দীপেন বললো, “একটা অ্যাপ আছে যেখানে নানান তথ্য দিলে বলে দেয় যে কত কার্বন আমরা দৈনন্দিন জীবনে উৎপাদন করি, মানে গাড়ি ব্যবহার করলে খুব বেশি, বাসে গেলে মাঝারি আর হেঁটে গেলে শূন্য!”

“ব্রিটিশ পেট্রোলিয়ামই ২০০৪ সালে প্রথম এই কার্বন ফুটপ্রিন্ট ক্যালকুলেটর চালু করে, আর এখন তো এনভায়রনমেন্টাল প্রটেকশন এজেন্সিরও অ্যাপ আছে। ভেবে দেখ তোরা নিউ ইয়র্ক টাইমসের মত পেপারে লেখা বেরোচ্ছে কি করে কার্বন ফুটপ্রিন্ট কমাবি! বিশ্বের তেলের অন্যতম মালিকরা বোঝানোর চেষ্টা করছে যে জলবায়ু পরিবর্তনের জন্যে তোর আমার অভ্যেস দায়ী, তুই আমি চেষ্টা করলেই নাকি কমবে গ্রীন হাউস গ্যাসের পরিমাণ!”

চা প্রায় শেষ, অন্ধকার নেমে আসছে। একটা ঠান্ডা বাতাস দিতে শুরু করেছে। ” মনোজ তুই আমায় বল, তোর এই ক্যালকুলেটরে এক কেজি কচি পাঁঠার মাংস তৈরি হতে কত কার্বন পুড়েছে বলা আছে। আচ্ছা বিদেশে ছাগল বা গরুর ইন্ডাস্ট্রি স্কেলে তৈরি হওয়া মাংস, যার খাবার যায় আমাজন থেকে সেই মাংসের ফুটপ্রিন্ট আর গুরুং এর পোষা ছাগল বড় হয়ে আমার প্লেটে আসতে কি একই কার্বন নিঃসরণ করে নাকি!”

মাথা চুলকে মনোজ দাজু ঘাড় নাড়িয়ে বোঝালো যে তার কাছে এর উত্তর নেই।

দেব কুমার বাবু বলে চলল “এনার্জি সেক্টর মানে বিদ্যুৎ, ট্রান্সপোর্ট এবং ইন্ডাস্ট্রি মিলিয়ে টোটাল গ্রিনহাউস গ্যাসের প্রায় ৩/৪ অংশ নিঃসরণ করে, সেখানে গবাদি পশু পালনে নিঃসৃত হয় মাত্র ৬ শতাংশ। তোর মনে হয় মনোজ, তুই আমি সবাই নিরামিষ খেলে আর গাড়িতে না চড়লে ক্লাইমেট চেঞ্জ হবে না! আসলে এরা চায় যে আমরা ভাবি যে আমরাই কারণ। আমাদের উপরে দোষটা দেওয়াটা সবথেকে সোজা। আমরা খাওয়া-দাওয়া চলাফেরা বন্ধ করে দিন আর উনারা দিব্যি তেল তুলে কয়লা তুলে টাকা করতে থাক।”

দীপেন এতক্ষণ চুপ করেছিল। হঠাৎ বলে উঠলো ” ঠিকই বলেছ, কদিন আগে শহরে জল জমলো, আর কিছু ছেলে মেয়ে ম্যানহোলের সামনে প্লাস্টিকের ছবি তুলে বলতে থাকলো আমাদের দোষ। আরে বাড়ি থেকে নোংরা নিয়ে যায় না, মানুষ নোংরা ফেলবে কোথায়!”

পুরোপুরি সন্ধ্যে হয়ে গেছে, মনোজ দাজু খানিকটা বিমর্ষ হয়ে পড়েছে। মুখ ফুটে বলল ” তাহলে বালব চেঞ্জ করে কোন লাভ নেই বলছো, পুরো এনার্জি সিস্টেম টা কে চেঞ্জ করতে হবে! কিন্তু আমরা কি কিছুই পারি না এর বিরুদ্ধে করতে?”

দেব কুমার বাবু ঠান্ডা হয়ে যাওয়া চায়ের শেষটুকু গলায় ঢেলে একটা পরিতৃপ্তির ঢেকুর তুলে বললেন, ” পারি মনোজ, আমরা প্রশ্ন করতে পারি। সরকারকে। ব্যাংক কে প্রশ্ন করতে পারি কেন তারা তেল আর খনি কোম্পানিকে ধার দিচ্ছে। আর আমাদের বাচ্চাদের শেখাতে পারি কিভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের হাত থেকে নিজেদের কে বাঁচাতে হবে। আমাদের বাঁচাবার শিক্ষা টা বড় দরকার রে মনোজ”

হাসি ফুটল মনোজের মুখে, আজ শেয়ার গাড়িতে ফিরবে সে। মোবাইল থেকে কার্বন ফুটপৃন্ট এর অ্যাপ টা ডিলিট করে দিল মনোজ।

মনোজ রাজুর গল্পের আরো লেখা পড়তে নিচের লিংকগুলোতে ক্লিক করুন।

মনোজ দাজুর গল্প ১ : কোভিড লকডাউনে কতটা থমকাল জলবায়ু পরিবর্তনের গতি?

মনোজ দাজুর গল্প ২: খাবারের গল্প

Leave a Comment