জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে বিভিন্ন স্কুলের বাচ্চাদের কাছে ডেমনস্ট্রেশন দেওয়ার সময় একটা প্রশ্ন বারবার উঠে আসে সেটা হল আমরা কি করতে পারি? জলবায়ু পরিবর্তন একটা বিশ্বজুড়ে হয়ে চলা ঘটনা। একজন সাধারণ মানুষ হিসাবে আমাদের সবার আগে যেটা করা দরকার সেটা হলো আমাদের কার্বন ফুটপ্রীন্ট বের করা।
কার্বন ফুটপ্রীন্ট হল আমাদের দৈনন্দিন কার্যকলাপের ফলে কতটা পরিমাণ গ্রীন হাউজ গ্যাস বাতাসে মিশেছে তার পরিমাপ। যেমন ধরা যাক একটা রংচঙে চিপসের প্যাকেট যার বিজ্ঞাপন আমরা সব সময় টিভিতে দেখতে পাই এবং একটি সাদা প্লাস্টিকে মোড়া লোকাল চিপসের প্যাকেট। দোকানে গিয়ে আমরা বিজ্ঞাপনের দৌলতেই হোক বা রংচঙে প্যাকেজিংয়ের আকৃষ্ট হয়ে অনেক সময়ই বহু বিজ্ঞাপিত চিপসের প্যাকেটটি কিনে ফেলি। এইবারে ভেবে দেখুন, সেই রংচঙে বহু বিজ্ঞাপিত চিপসের আলু এসেছে দেশের এক প্রান্ত থেকে, অন্য প্রান্ত থেকে এসেছে তেল ও মসলা। আপনার অঞ্চল থেকে বহু দূরের একটি জায়গায় এই চিপসটি ভাজা হয়েছে। তারপরে সড়কপথে বা বিমানে করে আপনার রাজ্যে পৌঁছেছে, এবং টেম্পো করে পৌঁছেছে সেই দোকানে যেখান থেকে আপনি চিপসের প্যাকেটটি কিনছেন। এইবারে যদি হিসেব করে দেখেন তাহলে আলু উৎপাদনের জন্য এবং আলু পরিবহন করে ফ্যাক্টরিতে আনার জন্য প্রচুর গ্রীন হাউজ গ্যাস নির্গত হয়েছে। তারপর যন্ত্রে করে সেই আলু কাটা হয়েছে তেলে ভাজা হয়েছে এবং প্যাকেটে ঢুকিয়ে সিল করা হয়েছে, এই পুরো প্রক্রিয়াটাতেও যথেষ্ট পরিমাণে গ্রীন হাউজ গ্যাস তৈরি হয়েছে। তারপরে সেই চিপস গাড়িতে করে যখন আপনার নিকটবর্তী দোকানে পৌঁছচ্ছে, সেই গাড়ি থেকেও প্রচুর পরিমাণে গ্রীন হাউজ গ্যাস বেরিয়েছে। অপরদিকে যদি দেখেন লোকাল চিপসের আলু এবং তেল এসেছে আপনারই পাশের মাঠ থেকে, একটা ছোটখাটো দোকানের এক পাশে হাতে আলু কেটে নুন মিশিয়ে, ওখানেই প্যাকেট করে, সাইকেলে করে দোকানে দোকানে দেওয়া হয়েছে। কাজেই এই যে লোকাল চিপসটি বানাতে অনেক কম গ্রীন হাউজ গ্যাস নির্গত হয়েছে।
এই রকম ভাবেই আপনি কী খাচ্ছেন, কোথায় যাচ্ছেন, কিসে করে যাচ্ছেন, বাড়িতে কটা লাইট ফ্যান, কজন ফ্যামিলি মেম্বার এইসব হিসেব করে আপনার পরিবারের কতটা গ্রীন হাউজ গ্যাস বেরোয় তার হিসেব করা হয়। এই মোট গ্রীন হাউজ গ্যাস যা আপনার বিভিন্ন অ্যাক্টিভিটির দাঁড়া বাতাসে মিশে তাকেই বলা হয় আপনার কার্বন ফুটপ্রীন্ট। দেখা গেছে একজন আমেরিকান নাগরিক এর তুলনায় একজন ভারতীয় নাগরিকের কার্বন ফুটপ্রীন্ট তিনগুণেরও কম হয়।
যেখান থেকে আমরা শুরু করেছিলাম আলোচনাটা, যে কি করলে আমরা জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারি। একজন সাধারন মানুষ হিসাবে আমাদের সব থেকে আগে জরুরি হলো নিজেদের কার্বন ফুটপ্রীন্ট কমানো। সুইডেনের একদল বৈজ্ঞানিক ২০১৭ সালে একটি বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান চালায় তাতে কোন কোন জিনিস কমালে বাড়ালে কার্বন ফুটপ্রীন্ট কমবে তার একটা লিস্ট তারা প্রকাশ করে। চলুন দেখে নেই সেই লিস্ট এ কি কি আছে!
সবথেকে বেশি কার্বন ফুটপ্রীন্ট কমবে যদি সন্তানের সংখ্যা কমানো যায়। দেখা গেছে এতে আপনি বছরে চব্বিশ হাজার থেকে এক লাখ কিলোগ্রাম অব্দি গ্রীন হাউস গ্যাসের নির্গমন কমাতে পারেন। এর পরেই আছে গাড়ি ছাড়া জীবনযাপন। তৃতীয় স্থানে আছে বিমানে কম ওঠা। তারপরেই আছে নিরামিষ খাবার খাওয়া। এই চারটি অপশনকে বৈজ্ঞানিকরা বলছেন হাই ইম্প্যাক্ট একশন। অর্থাৎ যাতে কিনা সবথেকে বেশি গ্রিন হাউস গ্যাসের নির্গমন আপনি আটকাতে পারবেন।
এছাড়াও আছে ঘরের ঠান্ডা গরমের জন্য এসি বা হিটার এর ব্যবহার কমানো, গণপরিবহন এবং সাইকেল ব্যবহার, সোলার প্যানেল লাগানো, খাবার কম নষ্ট করা, লোকাল খাবার খাওয়া, জল বাঁচান, জিনিসের পুনর্ব্যবহার, গাছ লাগানো এবং কম্পোস্টিং।
তাহলে আমাদের কার্বন ফুটপ্রীন্ট কত তা দেখে নিন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এই লিংকটিতে ক্লিক করে। তারপরে সম্ভব হলে উপরের পদ্ধতিগুলোকে অনুসরণ করে আমরা সবাই মিলে চেষ্টা করি আমাদের দৈনন্দিন জীবনে কার্বন ফুটপ্রীন্ট কমাবার।
তবে বলে রাখা ভালো এখানে একটা কিন্তু আছে। কিন্তুটি হল একটা সমান অধিকারের জায়গা। একটু পিছিয়ে পড়া এবং বঞ্চিত মানুষদের জীবনযাত্রা লক্ষ্য করলে দেখা যায় তাদের চাহিদা এতটাই কম যে তাদের কার্বন ফুটপ্রীন্ট ও অত্যন্ত কম। তাদের কার্বন ফুটপ্রীন্ট কমাতে গেলে হয়তো তাদের শারীরিক এবং মানসিক ভাবে আঘাত করা হবে। এটা কখনোই কাম্য নয়। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সাম্যবাদ ভুলে গেলে হবে না।