টুকিটাকি

অসাম্য, বায়ুদূষণ এবং রান্না

ইনডোর পলিউশন বা ঘরের মধ্যে হওয়া বায়ু দূষণ মানুষের স্বাস্থ্যের পক্ষে অত্যন্ত ক্ষতিকারক সেই ব্যাপারে বৈজ্ঞানিকদের মধ্যে কোন দ্বিমত নেই। ঘরের মধ্যে হওয়া দূষণের মূলত উৎস হচ্ছে কাঠ কয়লা এবং অন্যান্য জ্বালানি ব্যবহার করে রান্না করা। কাঠ-কয়েলের তুলনায় এলপিজি অপেক্ষাকৃত অনেকটাই কম বায়ু দূষণ সৃষ্টি করে। তাতে যারা রান্না করছেন তাদের শরীর-স্বাস্থ্য ভালো থাকা সম্ভবনা বেশি হয়।
ঘরের মধ্যে হওয়া এই দূষণ কিন্তু বাইরের দূষণ কেউ প্রভাবিত করতে পারে। এই প্রসঙ্গে একটি অন্যতম উল্লেখযোগ্য স্টাডিতে দেখা গেছিল যে যদি সম্পূর্ণভাবে গোটা ভারতবর্ষের প্রত্যেকটি গৃহস্থলী এলপিজি ব্যবহার শুরু করে তাহলে বাইরের বায়ু দূষণ কমে যাওয়ার প্রভূত সম্ভাবনা।
সম্প্রতি আমরা একটা নতুন স্টাডি করেছি যা সায়েন্স অফ দা টোটাল এনভায়রনমেন্ট নামক একটি আন্তর্জাতিক পত্রিকাতে প্রকাশিত হয়েছে। আমাদের এই পরীক্ষা-নিরীক্ষার মূল উদ্দেশ্য ছিল বিভিন্ন সরকারি স্কিম কতটা এলপিজি ব্যবহারকে প্রভাবিত করেছে এবং তার ফলে বায়ু দূষণের কোন পরিবর্তন হয়েছে কিনা সেইটি দেখা। শেষ চার থেকে পাঁচ বছরে কোটি কোটি এলপিজি কানেকশন নতুনভাবে দেওয়া হয়েছে। গোটা ভারতবর্ষ জুড়ে পাঁচ বছর অন্তর একটি সার্ভে হয়, যা ভারতবর্ষের প্রত্যেকটি জেলায় মানুষের স্বাস্থ্য, পরিবার এবং রোগ ইত্যাদি নিয়ে বাড়ি বাড়ি ঘুরে তথ্য সংগ্রহ করে থাকে। আমরা উজ্জ্বলা যোজনার আগের বছর (২০১৫-১৬) এবং দুই হাজার কুড়ি একুশ সালের সারা ভারতের ওপর এই সার্ভের ডেটা নিয়ে কাজ করেছি।
আমাদের প্রাথমিক অনুসন্ধান বলছে যে এটা ঠিক উজ্জ্বলা যোজনা শুরু হওয়ার পরে দেশের একটা বেশ বড় অংশের মানুষের কাছে এলপিজি পৌছে গেছে। কিন্তু সব থেকে গরীব যে অংশটি, সেখানে কিন্তু দেখা যাচ্ছে যে মাত্র ৭ থেকে ১৫ শতাংশ মানুষের কাছে এলপিজি গ্যাস পৌঁছেছে। অর্থাৎ সরকারি এই স্কিমের সুবিধা কিন্তু আসলে গরীব মানুষেরা নিতে পারছে না। এর সাথে সাথে আমরা আরও একটা জিনিস লক্ষ্য করেছি যে গ্রাম হোক বা শহরে, এলপিজি ব্যবহারে সংখ্যা কিন্তু মানুষের সম্পদের সাথে সমানুপাতিক। অর্থাৎ কিনা, মানুষের কাছে সম্পদ বাড়লে সে আস্তে আস্তে এলপিজি ব্যবহারের দিকে ঝুঁকছে।
নতুন এলপিজি ব্যবহারের ক্ষেত্রেও কিন্তু একটা উত্তর ভারত এবং দক্ষিণ ভারতের মধ্যে পার্থক্য দেখা গেছে। দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলি যেখানে প্রবল ভাবে এলপিজি ব্যবহার শুরু করেছে উত্তর ভারত কিন্তু সেই দিক থেকে পিছিয়ে পড়েছে।
শুধুমাত্র নতুন কানেকশন নিলেই তো হবে না এলপিজি ব্যবহার করতে হবে নিয়মিত। আমরা আমাদের এই অনুসন্ধানে দেখিয়েছি যে এলপিজি কানেকশন হয়তো ফ্রিতে পাওয়া যাচ্ছে বলে মানুষ নিচ্ছেন কিন্তু খুব কম পিছিয়ে পড়া মানুষের ফ্যামিলি পরবর্তীকালে তৃতীয়বার এলপিজি রিফিল করছেন। সাবসিডির অত্যন্ত কমে যাওয়া এর পেছনে বড় কারণ। ইতিমধ্যেই এই উজ্জ্বলা যোজনার সাফল্য ঘোষণা করে আস্তে আস্তে এটিকে তুলে দেওয়ার কথা চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে যার আমরা তীব্র বিরোধিতা করেছি। শুধুমাত্র সাবসিডি বা প্রথম গ্যাসটি ফ্রি দিয়ে যে এলপিজি ব্যবহার বাড়ানো যাবে না তা সত্য। সামগ্রিকভাবে যদি মানুষের কাছে সম্পদ বেশি না থাকে বা পয়সা বেশি না থাকে তাহলে কিন্তু এই ধরনের সাবসিডি অচিরেই ব্যর্থ হবে।
এই কাজটিতে আমরা আরো দেখিয়েছি যে যদিও কোটি কোটি নতুন পরিবার এলপিজি ব্যবহার করছে বলে দাবি করা হচ্ছে কিন্তু তাতে বাইরের বায়ু দূষণের বিন্দুমাত্র কোন পরিবর্তন হচ্ছে না। অর্থাৎ এক কথায় বলা যায় যে বর্তমান এই স্কিমের দ্বারা বায়ু দূষণ কিন্তু কমানো বিশেষ সম্ভব নয়। বায়ু দূষণ একটি অত্যন্ত জটিল বিষয় যেখানে একাধিক উৎস ভারতবর্ষের মতো দেশে আছে। এবং সেখানে শুধুমাত্র একটি উৎস কে ফোকাস করে অতিসরলীকরণ করলে বায়ু দূষণ কমা সম্ভব নয়।

Leave a Comment