টুলকিট

রানারের ডাইরি

রানারের ডাইরি

লেখক পরিচিতি : নীলাঞ্জন মিশ্র

Nilanjan

 —————————————————————————————————————

আবহাওয়ার খবরে জানা গেছে ২০২১ সালের ২৬শে মে উড়িষ্যা ও গাঙ্গেয় দক্ষিণবঙ্গে সুপার সাইক্লোন ইয়াস আছড়ে পড়বে। এইত সেদিন ২০২০’র মে মাসের ২০ তারিখেই আম্পান গেলো! সে ক্ষত শুকোতে না শুকোতেই আবার ঝড়! একদিকে ঝড় বন্যা। অন্যদিকে কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউ এবং দীর্ঘ লকডাউন। গ্রামের পর গ্রাম উজাড় করে কতো ছেলে অন্য রাজ্যে যাচ্ছে আবার ফিরে আসছে। ফিরে এসে গ্রামে কাজ পাচ্ছেনা। প্লাম্বার, রঙের মিস্ত্রী, এইকল ওইকলের মিস্ত্রী, গ্রামে এত কাজ কোথায়? আবার ভাগচাষ, দিনমজুরি, নৌকায় হেল্পারি। একটা পরিবার নাকি ৮ মাসে ৫,০০০ টাকা রোজগার করেছে। করোনার দ্বিতীয় ঢেউ চলতে চলতেই যাদেরকে বাধ্য হয়ে আবার ফিরে যেতে হবে দিল্লীতে!

বঙ্গোপসাগর পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ দিকে। যেখানে দক্ষিণ ২৪ পরগণা বলে একটি জেলা ও দক্ষিণ সুন্দরবন বলে একটা অংশ আছে। তার মধ্যে নামখানা সাগরদ্বীপ পাথরপ্রতিমা কাকদ্বীপ ডায়মন্ডহারবার আমার বাড়ির কাছাকাছি। সবই ৫০ কিলোমিটারের মধ্যে। কপিলমুনির আশ্রম, মৌসুনী, বকখালি ছাড়া আর তেমন টুরিস্ট স্পট নেই। লঞ্চ, ডিজে, দেশী মদ মুরগি কাঁকড়ার ঝোল, বাঘ ইত্যাদি নেই। তা বাঘ থাকলেও প্রায়ই তাকে এখানে ওখানে দেখা যায় এমনও নয়। না দেখতে পাওয়াই ভালো তবে কুমির আছে। বিরাট বিরাট অ্যালিগেটর! আর প্রচুর পাখি। প্রচুর গাছপালা, অনেক মানুষ, কিছু শুশুক এইসব। আমি পাথরপ্রতিমা ব্লকে থাকি। পনেরোটা নদীবেষ্টিত দ্বীপ আর কমবেশি চার লক্ষ মানুষ নিয়ে এই ব্লক তৈরী। কেউ কেউ এর নাম জানে। অনেকে জানেনা। প্রায় একটিও টুরিস্ট স্পট নেই। বিখ্যাত হতে গেলে টুরিস্ট স্পট থাকবার প্রয়োজন হয় যদিও সুন্দরবনের অন্যত্র টুরিস্ট স্পট ও ট্যুরিজমের স্বরূপ প্রত্যক্ষ করে আমরা অনেকেই এখানে টুরিস্ট স্পট আর “ত্রাণ টুরিজম চাইনা”। তবে বিখ্যাত না হতে পারার কিছু সমস্যাও আছে। যেমন, বঙ্গোপসাগরের একেবারেই ওপরে হওয়া সত্তেও ইয়াস সুপার সাইক্লোনের উইকিপিডিয়া বিবরণে কোনো ন্যূনতম উল্লেখটুকু না থাকা। একটু অসম্মানিত বা অপমানিত লাগে বৈকি!

তবে প্রথম চৌধুরী’র কথা এখানে মনে করে নিজেকে একরকম প্রবোধ দিই। ” মানের অভাব হইলে অভিমান হয়”। এই কথা কিন্তু আসলে ঠিক। দক্ষিণে সর্ষের ভেতরে ভূত বড় বালাই। সেসব কথা এখনই এতো খোলাহাটে বলবার মতো ওজন আমার হয়নি বলে মনে করি। এই সেদিনের ছেলে কাঁদলে চোখ দিয়ে এখনো নোনাজল বেরোয় তার এতো জাহাজের খবরে আগ্রহ কি!

২৬ শে মে সুপার সাইক্লোন আসবে। বিভিন্ন জায়গায় পুরীর পান্ডাদের ডাকের মতো আবহাওয়ার খবরের ডাক হচ্ছে। মেলা হইচই৷ আমি IMD ছাড়া অন্য কোনো খবরে কান দিচ্ছিনা। মাঝে মাঝে ওয়েবসাইট দেখছি। দু ঘন্টা অন্তর অন্তর বুলেটিন পড়ছি, ভিডিও দেখছি। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে এবারে ঝড়ের গতিবেগ ৮০-১১০ কিমি/ঘন্টা থাকবে। এ গতিবেগে বিরাট ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা নেই। কিন্তু একা ঝড়ে রক্ষা নেই! ভরা কোটাল আর জলোচ্ছ্বাস দোসর! এদিকে পুকুর খাল সব জলে ভরা। আমি ২৫ শে মে গোপালনগর গ্রাম পঞ্চায়েতের ৮৮ নং বুথে দাঁড়িয়ে আছি। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামছে। এই অংশটাকে মিঠাপুকুর বলে। রামগঙ্গা ছুঁয়ে সেলেমারী নদী আমাদের দ্বীপকে বেড় দিয়ে সপ্তমুখীতে মিশে চলে যাচ্ছে ববঙ্গোপসাগরের দিকে৷ মিঠাপুকুর প্রতিবার ভাঙে। রামগঙ্গার কূলটাকে নদী এখন গড়ছে। মিঠাপুকুরকে ভাঙছে। মিঠাপুকুর অংশে নদীর পাড় একেবারে খাড়া। অনুভূমিক কোনো চর বলতে গেলে নেইই৷ সবমিলিয়ে ঠিক দু তিনটে লবণাম্বু উদ্ভিদ। ব্যাস এই। এইত সেদিন আম্পানে গোটা গ্রামটা আট দশদিন পুরো পচা নোনাজলে ডুবেছিলো। আমরা কজন মিলে নোনাজল নিষ্কাশনের কাজ করছিলাম টাকাপয়সা তুলে৷ কাজটা সরকারের করার কথা। উদ্যোগ নিয়ে একশ’ দিনের কাজে তালিকাভুক্ত করার কথা কিন্তু সে আর করছে কে!

যাইহোক, আমি এসেছি আবহাওয়ার খবর প্রচার করতে। একদিকে আমার ভাই বোনেরা( হিরণ্ময়, সৌভিক, লোনা) IMD’র খবর বাংলায় অনুবাদ করছে, তিতাস ভাই বার্লিনে বসে সেই বাংলা খবরকে পোস্টারে পরিণত করছে। আমি বিভিন্ন দ্বীপের বন্ধুদের কাছে তা ছড়িয়ে দিচ্ছি whatsapp মারফত। নিরন্তর ফোনে যোগাযোগ হচ্ছে ব্রজবল্লভপুর, বনশ্যামনগরের সঙ্গে। আর স্কুটার নিয়ে সশরীরে আবহাওয়ার খবর প্রচারে আমি যাচ্ছি গোপালনগর গ্রামে। একদিন গেলাম পশ্চিম দ্বারিকাপুর আদিবাসীপল্লীতে। এই কাজ ১৯শে মে থেকে চলছে। আম্ফানের কাজের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের কাজেও কিছু পরিবর্তন ঘটাতে চাইছি। সারা গ্রামে তাই এভাবে খবর দিতে লাগলাম। গ্রামবাসীই বললেন ৭০ কিলোমিটার/ঘন্টা গতিবেগে হাওয়া বইলেই গোটা গ্রাম ডুবে যাবে। মানুষের আর কি করার আছে এখানে! প্রস্তুতি নেওয়া ছাড়া! তাও সব গ্রামে যদি যথাযথ ফ্লাড শেল্টার থাকতো! গোপালনগরে নেই, দূর্বাচটিতে নেই অথচ একেবারে নদী ঘেঁষে এই গ্রামগুলি। ২৪, ২৫ শে মে দুদিনই দেখলাম জোয়ারের জলের সর্বোচ্চসীমা প্রায় বাঁধের মাথা ছুঁয়ে ফেলেছে। রামগঙ্গার কোণ বেঁকে সেলেমারী ভীষণ জোরে জোরে মিঠাপুকুরের পাড়ে ধাক্কা দেয়। তাই পাড়ের নীচের দিক একেবারে ক্ষয়ে গেছে। বঙ্কিম মাইতির ঘাট ভেঙে জলে ডুবে গেছে। জোয়ারের সর্বোচ্চ সীমা থেকে আর চাকরখানেক উঠলেই রিং বাঁধের ভেতর জল ঢুকে যাবে। এমতাবস্থায় দেখি মরার কালে হরিনাম করতে এসেছে একটি ড্রেজার! বাঁধে ঘুরে ঘুরে একটু করে মাটি তুলে আবার বাঁধের ওপর মাটি ফেলে পিঠ চাপড়ানোর মতো মাটিটাকে চাপড়ে দিচ্ছে। এই কাজ এতদিন মানুষে কড়া কোদাল আর হাত দিয়ে করতো। সে কাজের মজবুতি ছিলো অনেক বেশি। ড্রেজার যতবড়ো আবিষ্কার হোক হাতের চেয়ে স্বাধীন আর শক্তিশালী হতে পারে কি! ওদিকে শ্রমিকদের পেটের ভাত গেলো মারা। আজকাল এলাকায় দেখি কেউ কেউ হয়েছে ড্রেজারমালিক আর কেউ কেউ হয়েছে সুপারভাইজার। অর্থাৎ দালাল। যে বিভিন্নভাবে টাকা চুরি করবে আর কি! গ্রামে এসবের খুব আলোচনা হয় কিন্তু মুখে মুখে প্রতিবাদ হয় বলে মনে হয়না।

নির্জন বাঁধে ঘুরে ঘুরে ড্রেজার কাজ করছে। আগামীকাল ঝড় হবে, জল আসবে। ঝড়ের আগের সন্ধ্যায় নদীর জল যেভাবে ফুলে উঠেছে তাতে বোঝা গেলো গ্রাম আবার ডুবতে চলেছে। ততক্ষণে চাঁদ উঠেছে। বাঁধের গায়ে কয়েক পরিবার ঘর বেঁধে আছে। পঞ্চায়েত থেকে একজনকে পাঠানো হয়েছে রাতারাতি তাদেরকে তুলে দেওয়ার জন্য৷ কোনো উপায়ও নেই। না উঠলে জলে ডুবে মরবে সবাই। খুব একচোট ঝামেলা হচ্ছে। ঝামেলা শেষ হতে দলীয় প্রতিনিধি ওয়ার্নিং দিয়ে গেলো, আগামীকাল সকাল সাতটার মধ্যে এখানে যেনো কাউকে না দেখা যায়! রিং বাঁধের ওপর একঘর সাঁওতালের বাস। মাটির রঙ দেখেই বোঝা যায় এ ঘর সাম্প্রতিক তোলা হয়েছে। এতো খারাপ লাগছিলো। এই সবে ঘর তুলেছে আবার ভেঙে যাবে! দু চারজন প্রতিবেশী এসে বঙ্কিম মাইতির ভাঙা ঘাটে এসে বলছে, এবারেও একটু সাহায্য করবেন! কি সাহায্য করবো বলুন? প্রতিবার বন্যা হবে ত্রাণ আসবে, সরকার হাঁড়ি কড়া দেবে, আমরা পুকুর থেকে নোনাজল নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করবো। এভাবে কি দীর্ঘমেয়াদী কোনো সমাধান হবে? কোনো উত্তর নেই। কেউ হাসে। কেউ বড়জোর বলে, হ্যাঁ তা তো ঠিক!

যে পরিবারের লোকজন খুব কোন্দল করছিলো, একটু এগিয়ে গিয়ে রাগত স্বরেই বলি, গতবছর গোটা মিঠাপুকুর ডুবে গিয়েছিলো। এক কিলোমিটার দূর থেকে পচা গন্ধ পাওয়া যেতো। আমরা পচা জল সরিয়েছিলাম। আপনারা গত বছরের মে মাস থেকে এবছরের মে মাস অবধি এক বছর চার দিন কি করলেন? ডুবে যাওয়া এই গ্রামের সবাই বসেছিলেন কোনো মিটিং-এ? সবাই মিলে পঞ্চায়েতে, বিডিও অফিসে গিয়ে বসে কোনো সুরাহা খুঁজেছিলেন? কোনো উত্তর নেই। গলা নেই। সব ঠান্ডা। চুপ। আবার জিজ্ঞেস করছি, একবারও মনে হলোনা আবার ঝড় বন্যা হতে পারে? আপনাদের প্রতিবেশিরা বলছে আপনারা নাকি পাঁচ সাত লাখটাকার ঘরের কাঠামো খাড়া করে টাকা যোগাড় করে উঠতে পারছেন না বলে গ্রামের ভেতরে সে ঘরের কাজ বাকি ফেলে রেখেছেন? একথা সত্যি? সত্যি। সাধ্যে নেই অথচ মাথা গোঁজার ঠাঁই একটা আগে না করে এখানে এই নদীর ধারে এসে আছেন! আপনাদের এই দুখানা করে ঘরের এই গল্প আর কদ্দিন চলবে বলতে পারেন? প্রসঙ্গত দুখানা ঘর রেখে একটি দুর্দশাগ্রস্ত ঘরের ছবি ঝড়ের পরেরদিন দেখিয়ে সরকারী সাহায্য নেওয়ার ফিকির এখন একটা ট্রেন্ড। কী যে ঘেন্না হয়!

যাইহোক কোনো উত্তর নেই। কীই বা বলবে। আরেকবার বললাম, আপনারা কি মনে করেন সরকার এই সাত লাখ টাকা দেবে আপনাদের? আচ্ছা মনে করুন আমার দশলাখ লাগবে ঘর বানাতে। আমি আপনি সবাই যদি চাই টাকা সরকার দেবে কোথা থেকে? প্রকল্পে পাওয়া যায় তো বড়জোর দুলাখ। তাই দিয়েই প্রথমে মাথা গোঁজার ঠাঁই করার দরকার ছিলোনা কি? আমারই শুনে কেমন ভয় করছে। আগামীকালের মধ্যে সব ছেড়ে দিতে হবে। কি করবেন এখন? ঠিক আছে যান প্রস্তুতি নিন। হাঁস মুরগিগুলোকেও তো সঙ্গে নিয়ে যেতে হবে।

একেবারে সন্ধ্যা নেমে গেছে। বাড়ি ফিরতে হবে। উত্তর পশ্চিম কোণে মেঘ করে আসছে। যাওয়ার আগে রবিনকে বলি, ভাই খবর দিও। আজ রাতেই হয়তো জল ঢুকবে।

রাগ আমার যেমন আকস্মিক, ঠান্ডা হয়ে যাওয়াও ততো তাড়াতাড়ি। ফিরতে ফিরতেই মনখারাপ করতে শুরু করলো। সাঁওতাল পরিবারের নতুন ঘরটা ছেড়ে দিতে হবে। এইত বিকেলে দেখছিলাম একবাড়ির বউ চুনোমাছ কাটছিলো। তারা কখন রান্না করবে কখন খাবে আর যাবে কখন। গোপালনগরে কোনো ফ্লাড শেল্টার নেই। শুনেছি একেক টার্মে পাঁচ বছরে পঞ্চায়েত মোট ছ’কোটি টাকা করে পায়। একেকবছর এক কোটি কুড়ি লক্ষ টাকা। সে টাকার ন্যূনতম ৬০% খরচ করে সে বছরের ডিসেম্বর মাসে তার হিসেব দেখাতে হয়৷ যাইহোক আমিই বা আদার ব্যাপারীর চাইতে বেশি কি! জাহাজের খবর নিতে গেলে হয়তো ডুবে যাবো। এরাই বা জানে কি। আমরা সবাই এক তো। বাধ্য নিরূপদ্রব নিরীহ নাগরিক।

কিন্তু আজ এই মুহূর্তে? এসব ভাবার মানেই বা কি। একরাতে ঘর ছেড়ে অন্যত্র উঠে যাওয়া সহজ? ততোক্ষণে অনেক বাড়ির মেয়েরা বাচ্চাদের নিয়ে কাছাকাছি স্কুল ও পাকাবাড়ির দিকে চলেছে। প্রাইমারী স্কুলগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই উঁচু নয়। অনেকেই যাবে চারিদিক ঘেরা পাঠমন্দির স্কুলে। সঙ্গে গরু বাছুর। পাঠমন্দির অনেকদূর। এতকিছু সঙ্গে করে এতটা হাঁটা! জানিনা এভাবে আর কতদিন চলবে।

রাত প্রায় ১২ টা বাজছে তখন। বাঁধের ধারে উত্তাল হাওয়া। রবিন ভিডিও কল করলো। হাওয়ার শব্দে কিচ্ছু শুনতে পেলাম। রবিন ভিডিও পাঠাতে দেখলাম রাতেই গ্রামে জল ঢুকতে শুরু করেছে। সাইক্লোন তখন কতদূর। ল্যান্ডফল তো পরেরদিন বেলা ১১টায় হবে!

2 Comments

  • বাহ্, ঝরঝরে সুন্দর গদ্যে বাস্তবের ধারাবিবরণী পেলাম!

    • ধন্যবাদ ইন্দ্রাণী। এমন গদ্য লিখে যেতে চাই।

Leave a Comment