প্রতিবেদন

মনোজ দাজুর গল্প 8 – হারপ দিয়ে জলবায়ু পরিবর্তন

আজকে দেবকুমার বাবু এসেছেন মনোজ দাজুর বাড়ি। বেশ কয়েক দিন ধরে মনোজের পাত্তা নেই। তার ওপর অসময়ের বৃষ্টি হয়ে আরো মুশকিল হয়ে গেছে। মনোজের বাড়ির কাছে ফোনের নেটওয়ার্ক সব সময় পাওয়া যায় না। তাই আজ একটু বেলা থাকতে দেবকুমার বাবুই বেরিয়ে পড়েছেন। মনোজের বাড়ি হেঁটে পৌঁছাতে লাগলো প্রায় ঘণ্টা খানেক। দুপুরের কাঞ্চনজঙ্ঘা সোনালী রোদ ঝলমলে।

মনোজের বউ কোমল ছাদে রোদে বসেছিল, দুর থেকে দেবকুমার বাবুকে আসতে দেখে দৌড়ে নিচে নেমে এলো। এই মনোজ, ছিরিং, রমেশ বা দীনেশের মত অনেকেই দেবকুমার বাবুর থেকে বহু বার উপকৃত হয়েছে। তাই ওরা, ওদের পরিবার সবাই দেব কুমার বাবুকে ভালোবাসে, ভক্তি করে। ঘরে ঢুকে দেব কুমার বাবু দেখলেন মনোজ মোবাইল নিয়ে কীসব দেখছে আর পাতা ভর্তি লিখে যাচ্ছে। দেব কুমার বাবুকে দেখে মনোজ বলল, ভালোই হয়েছে এসেছেন। আজ পাড়ার কয়েকটা ছেলে মেয়েকে ডেকেছি। একটা বিষয়ে আলোচনার জন্যে। দেব কুমার বাবুর কৌতূহল চরমে পৌঁছাল। মনোজ নিজের মত থাকে, হঠাৎ পাড়ার ছেলে মেয়েদের ডেকে কি এমন বোঝাবে।

কিছু বলার আগেই মনোজ বলে উঠলো জানেন জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে না, একে পরিবর্তন করা হচ্ছে। দেব কুমার বাবু সহজ ভাবে বললেন , হ্যাঁ সে তো মানুষের গ্রীন হাউস গ্যাস নিঃসরণের জন্যে জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে। মনোজ দাজুর মুখ শক্ত হয়ে গেলো। বললো নানা, এটা কারণ না, এটা আমাদের বোঝানো হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের নাম নিয়ে গরীব দেশ গুলোতে সমস্ত কল কারখানা বন্ধ করার খেলা চলছে। আপনি হার্পের (HAARP) নাম শুনেছেন। দেব কুমার বাবু বয়স্ক এবং যথেষ্ট বুদ্ধি ধরেন কিন্তু মনোজের মুখে হারপের নাম শুনে দেব কুমার বাবুর একটু হলেও অস্বস্তি হতে শুরু করল। মনোজ অত্যন্ত যুক্তিবাদী ছেলে। সে যেমন প্রকৃতির সাথে বড় হয়েছে তেমনই পড়াশুনো করে যথেষ্ট বর্তমান বিজ্ঞানের বিশেষত জলবায়ু পরিবর্তনের সম্পর্কে জ্ঞান আছে। তার মুখে এই কথা শুনে দেব কুমার বাবু প্রমাদ গুনলেন।

যাই হোক, কোমলকে চা করতে বলে দেব কুমার বাবু শুরু করলেন মনোজকে বোঝানো। আচ্ছা মনোজ, তুই আমায় প্রথমে বল যে কার লেখা কথা পড়ার পর তুই হারপ নিয়ে জানতে পারলি ? একটু মাথা চুলকে মনোজ উত্তর দিল কেন গুগল করে, তার ওপর অনিল দাভে বলে ভারতের আগের পরিবেশ মন্ত্রি, তিনিও বলেছেন।

তিনি কি বৈজ্ঞানিক ছিলেন ? দেবকুমার বাবুর প্রশ্ন।

নানা, তা হতে যাবেন কেন। কিন্তু অত বড় একজন সরকারি লোক। মনোজ বলল।
আচ্ছা মনোজ তুই তো কদিন ধরে এটা নিয়েই পড়াশুনো করছিস, কোন বৈজ্ঞানিক পেপার, রিসার্চ পেপার বা এরকম কিছু পেয়েছিস। দেবকুমার বাবু বললেন।

না, তা পাইনি বটে কিন্তু ফেসবুকে এতো এতো লোক যে বলছে। মনোজের উত্তর।

আচ্ছা দেখ, শুরুতে যখন বৈজ্ঞানিকরা জলবায়ু পরিবর্তন আসলে আমাদের নিঃসরণ করা গ্রিন হাউস গ্যাসের জন্যে হচ্ছে বলতে শুরু করলেন, তখন ফসিল ফুয়েল কোম্পানির লোকেদের তিনটে বক্তব্য ছিল। এক, এটা আগেও হয়েছে, দুই, সূর্যের গতিপথ পরিবর্তন হয় কয়েক হাজার বছর পর সেই জন্যে হচ্ছে এবং তিন, এতে মানুষের কিছু হবে না। এরকম আরও বেশ কয়েকটা কারন ছিল। বৈজ্ঞানিকরা ধরে ধরে প্রত্যেকটা কারনের বিরুদ্ধে প্রমান দেওয়ার পর বাজারে হারপ তত্ত এলো। এর আগে, ফসিল ফুয়েল লবি যা কারন দেখাচ্ছিল সেগুলোর পেছনে অল্প হলেও মিথ্যে কিছু প্রমান দেখিয়েছিল, ফলে সেগুলোকে ভাংতে বিজ্ঞানীদের সুবিধা হয়েছিল। কিন্তু, এই হারপ হল গা জোয়ারি, মানে হ্যাঁ আমরা বলছি তাই হচ্ছে। বড়লোক দেশরা করছে। এক নিস্বাসে অনেকগুলো কথা বলে একটু হাঁফ নিলেন দেব কুমার বাবু।

অর্থাৎ আপনি বলছেন এখনও অব্দি যত কনস্পিরেসি থিওরি এসেছে তার মধ্যে সব থেকে অবৈজ্ঞানিক হল হারপ। মনোজের প্রশ্ন।

একদম, এর পর তো এরা বলবে যে উপগ্রহ থেকে পৃথিবীর যখন বিভিন্ন জিনিষ ম্যাপ করা হয়, সেই তরঙ্গ আসলে জলবায়ু পরিবর্তন করছে। দেখ প্রথমত, হারপ একটা রেডিও ওয়েভ ছাড়ে, যা কিনা আমাদের আবহাওয়ার মুল যে দুটি স্তর অর্থাৎ বায়ু মণ্ডলে (স্ট্রাটোসস্পিয়ার এবং ট্রোপোসস্পিয়ার) বিন্দুমাত্র কোন পরিবর্তন না করে, সোজা উঠে যায় আরও ওপরে অর্থাৎ আয়নস্ফিয়ারে। এবারে তুই বল মাটি থেকে ৬০-৮০ কিলোমিটার ওপরে ওই তরঙ্গ যার ক্ষমতা প্রায় নেই বললেই চলে, সেটা কি ভাবে মাটির আবহাওয়া নিয়ন্ত্রন করবে। দেবকুমার বাবুর উত্তর শুনে মনোজ খানিকক্ষণ চুপ করে থাকল। দিয়ে বলল তাহলে এরকম লোকে বলছে কেন।

প্রথমত, এতে ফসিল ফুয়েল লবির বড় হাত আছে। জলবায়ু পরিবর্তনের জন্যে যে তারাই দায়ী সেটা বুঝে গোটা বিশ্ব এখন ফসিল ফুয়েল থেকে সরতে চাইছে। কিন্তু এতো এতো টাকার ব্যবসা, ফলে ওরা এরকম একাধিক গুজব ছড়িয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করছে। ঠিক যেমন করেছিল কার্বন ফুটপ্রিন্টের কথা বলে। তবে, আমি এখনও একটা জিনিষ বুঝি না, সেটা হল, আমি বলতে শুনি যে আমেরিকা এবং ইউরোপ জলবায়ু কন্ট্রোল করছে, ওরাই দায়ী এই সাইক্লোনের জন্যে। কিন্তু আইপিসিসি রিপোর্ট বল বা অন্যান্য বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান, সব জায়গায় এটাই দেখানো হয়েছে যে আমেরিকা এবং ইউরোপ যে বিপুল গ্রীন হাউস গ্যাস নিঃসরণ করেছে শিল্প বিপ্লবের পর থেকে সেটাই জলবায়ু পরিবর্তনের জন্যে দায়ী এবং যা থেকে এই এতো সাইক্লোন বা বাজ বা তাপ প্রবাহ হচ্ছে। মানে বিজ্ঞানীরা এবং কনস্পিরেসি থিওরিস্টরা দুজনেই আমেরিকা এবং ইউরোপকে দায়ী করছে কিন্তু একদল যুক্তি দিয়ে আর একদল গায়ের জোরে।

মনোজ মাথা নাড়ল। বলল আচ্ছা মানুষ তো কৃত্রিম ভাবে বৃষ্টি ঘটাতে পারে – তাহলে জলবায়ু নিয়ন্ত্রন সম্ভব না কেন। দেব কুমার বাবু বললেন এই বারে তুই ভালো প্রশ্ন করেছিস। ক্লাউড সিড করে বৃষ্টি করানো ভীষণ ব্যয় বহুল এবং এরকম ভাবিস না যে বলে বলে করা সম্ভব। অনেক তথ্য লাগে, কি ধরনের মেঘ, কতটা বড়, কোথায় সিড করতে হবে, কোন সময় করতে হবে। প্রচুর যন্ত্র, প্লেন ইত্যাদি লাগে এই পরীক্ষা করতে। এত কিছুর পর ও কিন্তু নিসচয়তা নেই যে বৃষ্টি হবেই। বৃষ্টি তাও সহজ কিন্তু, আদ্রতা, তাপমাত্রা বা হাওয়ার বেগ গতিপথ বড় অঞ্চলে পরিবর্তন করার চিন্তাও অবাস্তব। যাই হোক, দেখ সব থেকে বড় প্রমান যে গ্রিন হাউস গ্যাসের জন্যেই জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে – সেটা হল জলবায়ু মডেল গুলির পূর্বাভাস। যত বছর যাচ্ছে, এই পূর্বাভাস মিলে যাচ্ছে বেশি বেশি করে। ফলে সন্দেহের কোন জায়গাই নেই বুঝলি।

ইতিমধ্যে কোমলের দেওয়া চা শেষ। আসতে আসতে সন্ধে নামছে। মনোজের বাড়িতে পাড়ার ছেলে মেয়েরা এসে গেছে। তাদের হারপের গল্প না শুনিয়ে মনোজ আগের বর্ষায় কোথায় কোথায় ধ্বস নেমেছে আর পরের বার কোথায় কোথায় সাবধান থাকতে হবে সেই গল্প শোনাচ্ছে। দেব কুমার বাবু একটু নিশ্চিন্ত হয়ে বাড়ির দিকে পা বাড়ালেন।

Leave a Comment