যখন জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে কথা বলা হয় বা বিশ্ব উষ্ণায়ন নিয়ে কথা বলা হয়, তখন যে বৈজ্ঞানিক ধারণাটির কথা আমরা বিস্তারিত ভাবে বলি না সেটা হল রেডিয়েটিভ ফোর্সিং। আমরা ইচ্ছে করেই এর বাংলা করলাম না।
রেডিয়েটিভ ফোর্সিং এর বৈজ্ঞানিক ধারণাটি অত্যন্ত সোজা সাপটা। সূর্যের রশ্মী পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল ভেদ করে পৃথিবীর মাটিতে শক্তি বহন করে আনছ। এই শক্তির ৩০ ভাগের কাছাকাছি প্রতিফলিত হয় আবার মহাকাশে ফিরে যাচ্ছে এবং বাকি অংশটি পৃথিবী শোষণ করছে। শোষণ করে পৃথিবী খানিকটা গরম হচ্ছে এবং যেকোনো গরম জিনিস যেমন তাপ ছেড়ে ঠান্ডা হয়, তেমন ভাবে আবার ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। এই কতটা শক্তি পৃথিবী প্রতিফলন করবে কতটা শোষণ করবে এবং কতটা আবার তাপের মাধ্যমে মহাকাশে চলে যাবে সেইটার একটা সাম্যবস্থা বা ইকুইলিব্রিয়াম আছে। সেইটা নির্ভর করে বাতাসে থাকা বিভিন্ন গ্যাসের উপরে আবার মাটির আচ্ছাদন কিরকম তার উপরেও। কিছু কিছু আটকে আছে যারা এই তাপ শক্তিকে আটকে রাখে। তেমনভাবেই মাটির ওপরে যদি বরফ থাকে তাহলে যতটা না শক্তি আটকে থাকে তার থেকে অনেক বেশি পরিমান শক্তি পৃথিবীতে আটকে থাকে, যদি বরফের জায়গা কংক্রিট থাকে।
শিল্প বিপ্লবের পর থেকে মানুষ কলকারখানা খুলেছে বা গাড়িঘোড়া বহুল পরিমাণে ব্যবহার শুরু করেছে, ঠিক তেমনই জঙ্গল কেটে চাষের জমি বা বাড়ী ঘরদোর বানিয়েছে। মানুষের এই কর্মকাণ্ডের ফলে শক্তির যে ইকুইলিব্রিয়াম এর কথা আমরা বলছিলাম, সেটা ঘেঁটে গেছে। আর কতটা ঘেঁটেছে সেইটা পরিমাপ করার এককই হচ্ছে রেডিয়েটিভ ফোর্সিং। যখন রেডিয়েটিভ ফোর্সিং এর মান শূন্য থেকে বেশি হয়, তখন বুঝতে হবে যে পৃথিবীতে যতটা শক্তি থাকার কথা (প্রতিফলন, তাপ হিসেবে নির্গমন, শোষণ ইত্যাদি যোগ বিয়োগ করে) তার থেকেও বেশি পরিমাণে শক্তি আটকে পড়ে আছে, অর্থাৎ কিনা পৃথিবী গরম হচ্ছে। আর যদি এটির মান শূন্য থেকে কম হয় তাহলে বুঝতে হবে যে পৃথিবী ঠান্ডা হচ্ছে। রেডিয়েটিভ ফোর্সিং এর একক ওয়াট পার মিটার স্কয়ার।
এইবারে আমরা দেখব যে পৃথিবীতে বর্তমানে কোন কোন জিনিসের জন্য রেডিয়েটিভ ফোর্সিং বাড়ছে যা জলবায়ু পরিবর্তন হওয়াচ্ছে।
নিচের এই ছবিটাকে জলবায়ু পরিবর্তনের দ্য লাস্ট সাপার বলা যেতে পারে। এতে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে 1750 থেকে 2011 সাল অব্দি মানুষের কর্মকাণ্ডের জন্য কোন কোন জিনিসগুলি রেডিয়েটিভ ফোর্সিং বাড়িয়েছে বা কমিয়েছে।
এখানে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে যে চারটি গ্রীন হাউজ গ্যাসের মধ্যে কার্বন ডাই অক্সাইড এবং মিথেনের অবদান সর্বোচ্চ। অন্যান্য গ্যাসের মধ্যে যে সমস্ত গ্যাস ওজন সৃষ্টি করে তারাও কিন্তু রেডিয়েটিভ ফোর্সিং বাড়াতে সাহায্য করেছে। যেমন ভোলাটাইল অর্গানিক কম্পাউন্ড, কার্বন মনোক্সাইড, নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড ইত্যাদি। এরোসল বা ধূলিকণা কিন্তু খুবই অদ্ভুত ভাবে রেডিয়েটিভ ফোর্সিং কে বাড়ায় বা কমায়। কিছু কিছু এরোসল যেমন সালফেট (যা সমুদ্র থেকে উৎপন্ন হয় আবার আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের ফলেও নির্গত হয়) সূর্যালোকে প্রতিফলিত করে রেডিয়েটিভ ফোর্সিং কমায়, আবার ব্ল্যাক কার্বন এরোসল (ভুসোকালি) কিন্তু সূর্যালোক কে শোষণ করে পৃথিবীকে আরো উষ্ণ করে। অর্থাৎ বিজ্ঞানীরা ঠিক নিশ্চিত ভাবে বলতে পারছেন না যে বায়ু দূষণকারী কণাগুলি পৃথিবীর তাপমাত্রা কে বাড়াচ্ছে নাকি কমাচ্ছে।
সবমিলিয়ে ২০১১ সালে, শিল্প বিপ্লবের আগের তুলনায় ২.২৯ ওয়াট পার মিটার স্কয়ার রেডিয়েটিভ ফোর্সিং বেড়েছে। এবারে এটা বুঝতে হয়ত একটু মুশকিল হতে পারে। মানে ২.২৯ ওয়াট পার মিটার স্কয়ার তো খুব সামান্য। আমরা বাড়িতে ১০০ ওয়াটের বাল্ব জ্বালিয়ে বসে থাকি কোন অসুবিধা হয় না তো!
এটা বুঝতে গেলে আমরা একটা সোজা অংক করি। পৃথিবীর সারফেস এরিয়া বা ক্ষেত্রফল হল ৫১০ মিলিয়ন স্কয়ার কিলোমিটার। ১ মিলিয়ন মানে ১০ লক্ষ আর ১ কিলোমিটার মানে ১০০০ মিটার। এইবারে ওই সামান্য সংখ্যাটি দিয়ে যদি এই ক্ষেত্রফলকে গুণ করো তাহলে গোটা পৃথিবীতে কত অতিরিক্ত শক্তি ঢুকছে খানিকটা বোঝা যাবে। ছোট করে বলে রাখি এই গুণটি করলে যে সংখ্যাটি পাবে সেটাকে লেখা হয় ৮০০ টেরাওয়াট হিসেবে যা কিনা সারা বিশ্বের মানুষের গড় ইলেক্ট্রিসিটি ব্যবহারের ৫০ গুণ বেশি।