কলমে অভ্র চক্রবর্তী
———————————————————————————————————
হে ভারত ভান্ডারে তব বিবিধ রতন
ভারতের প্রাকৃতিক সম্পদ বলতে সাধারণ ভাবে মনে হয় কয়লা নানান রকম ধাতব আকরিকের কথা। কিন্তু ভারতের বিপুল জীব বৈচিত্র্য যে একটা অনন্য প্রাকৃতিক সম্পদ সেটা অনেক সময়ই খেয়াল থাকে না। ক্রান্তিয় ও উপ ক্রান্তিয় অঞ্চল বিস্তৃত এই দেশ টি প্রাগৈতিহাসিক হিম যুগে বরফে ঢেকে যায় নি তাই এখানকার বহু উদ্ভিদ প্রজাতি অবলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিল। এই সুপ্রাচীন সভ্যতার মানুষ এই জীব বৈচিত্র্য কে চিনেছিল অধ্যয়ন করেছিল এবং জীবনের নানান প্রয়োজন মেটাতে এই সম্পদ কি করে ব্যবহার করা যায় সেই জ্ঞান রপ্ত করেছিল। শুধু তাই নয় বন্য প্রজাতি গুলি থেকে নির্বাচনের মাধ্যমে আশ্চর্য গুন সম্পন্ন নানান জাতের জন্ম দিয়েছিল। এই ভাবে ভারতে গড়ে উঠেছিল এক অসামান্য ফসল বৈচিত্র্য।
ভারতে প্রায় 3900 প্রজাতির উদ্ভিদ পাওয়া যায় যাদের থেকে মানুষের নানান প্রয়োজন মেটানো সম্ভব। এদের মধ্যে যেমন আছে খাদ্য উৎপাদক উদ্ভিদ তেমনি এই উদ্ভিদ প্রজাতিগুলি থেকে তন্তু, গৃহনির্মান সামগ্রী, পশুখাদ্য, পানীয়, মশলা, সুগন্ধি, ঔষধ, রঙ, আঠা, নেশার দ্রব্য, ঘর সাজানোর উপকরণ ইত্যাদি আরও অনেক কিছু পাওয়া সম্ভব। যুগ যুগ ধরে কৃষকদের নির্বাচনের ফলে এই সমস্ত উদ্ভিদের অসংখ্য জাত সৃষ্টি হয়েছে। যেমন সবুজ বিপ্লবের আগে শুধু ধানেরই লক্ষাধিক জাত ছিল। গোবিন্দ ভোগ বাদশা ভোগ ইত্যাদি সুগন্ধি জাত গুলির কথা অনেকেই জানেন। কিন্তু এমন ধানও আছে যা 50 ফুট গভীর জলেও দিব্যি ফলন দিতে পারে। আবার চরম খরা সহ্য করতে পারার মত ধানও আছে। এই ফসল বৈচিত্র্য জাতির সম্পদ। একটা সুস্থায়ী কৃষি গড়ে তোলার মেরুদণ্ড।
তা সবে অবোধ মোরা অবহেলা করি
সবুজ বিপ্লবের সময় থেকেই এই ফসল বৈচিত্র্যের দ্রুত অবক্ষয় শুরু হয়। কোন বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণ ছাড়াই ভারতের হাজার হাজার দেশী ধানের জাতকে নিম্ন ফলনশীল বলে দাগীয়ে দেওয়া হল। এমনকি বেশকিছু দেশীয় জাতের ফলন IR8 নামক সবুজ বিপ্লবের ধানের থেকে বেশী এমন বৈজ্ঞানিক তথ্য থাকা সত্বেও তাকে অস্বীকার করা হলো। সারা দেশ জুরে দু একটি তথাকথিত উচ্চফলনশীল ধান গমের চাষ চালু করার কারনে হাজার হাজার দেশীয় ধানের ও মিলেটের জাতের চাষ বন্ধ হয়ে যায় ফলে সেগুলি অবলুপ্ত হতে থাকে। এই ভাবে ভারতের প্রায় 90% ধানের জাত শেষ হয়ে গেছে।
ফসল বৈচিত্র্য কমেগেলে সামগ্রিকভাবে কৃষিবাস্তুতন্ত্রের উপর তার বিরুপ প্রভাব পরে ফলে রোগ পোকার উপদ্রব বাড়ে। রাসায়নিক ভাবে তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়। বর্তমানে ভারতে ধানক্ষেতে পোকার উপদ্রব 1960 এর দশকের তুলনায় 500% বেড়েছে। তথাকথিত উচ্চফলনশীল ধানের জলের চাহিদা মেটাতে মাত্রাতিরিক্ত ভৌমজল তোলার ফলে দেশের বহু জায়গায় আর্সেনিক দূষন বেড়েছে। এই বিদেশী উচ্চফলনশীল ধানগুলির খড়া বন্যা ইত্যাদি সহ্য ক্ষমতা খুবই কম, তাই প্রাকৃতিক দুর্যোগে সহযেই ফলন নষ্ট হয়। চাষী যদি আজ এর হাত থেকে পরিত্রান পেতে চায় তাহলে আবার সেই সাবেকি বীজই ব্যবহার করতে হবে। কিন্তু তার উপায় খুবই সীমিত। সাবেকি বীজ আর চাষীর হাতে নেই। বীজের বাজার জুড়ে আজ বহুজাতিক কোম্পানির দাপাদাপি।
হেই সামালো বীজ
সরকারি অবহেলায় ভারতের এই সমৃদ্ধ ফসল বৈচিত্র্য নিদারুণ অবক্ষয়ের মুখে। সরকারি প্রতিষ্টানগুলিতে যতটুকু বীজ সংরক্ষিত আছে তাও সাধারণ কৃষকদের নাগালের বাইরে। আজ থেকে 30 বছর আগেও বাংলার বিভিন্ন হাটে সাবেকি বীজ পাওয়া যেত আজ সর্বত্র বীজ কোম্পানির একচ্ছত্র দাপট। এই আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ইতিহাসের স্বাভাবিক নিয়মেই গড়ে উঠেছে প্রতিরোধ।
ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের অনেকগুলো সংগঠন দেশীয় বীজ সংরক্ষনের লক্ষে এগিয়ে এসেছে। তাদেরই যৌথ উদ্যোগে নাগপুরে সম্প্রতি (8/4/22-10/4/22) অনুষ্ঠিত হল বীজ উৎসব। এই উৎসবে প্রায় 50 ষ্টল ছিল। ষ্টলগুলিতে যেমন সাজানো ছিল ভারতের চোখ ধাঁধানো ফসল বৈচিত্র্য পাশাপাশি চলছিল বীজ কেনাকাটা। তামিলনাড়ু একটি সংগঠন নিয়ে এসেছিল 500 ও বেশী জাতের সব্জী বীজের এক বিপুল সংগ্রহ। তাদের কাছে শুধু লঙ্কারই এক বিচিত্র সংগ্রহ ছিল। ছিল ঘিয়ের সুগন্ধ যুক্ত লঙ্কা, ছিল লাল রঙের ফুলের মত দেখতে এক বিচিত্র আকৃতির লঙ্কা। সহজ বীজ নামে একটি ষ্টলে 100 রকম দেশী বিজের কম্বো প্যাক পাওয়া যাচ্ছিল। ছিল কন্দ ফসলের বিচিত্র সম্ভার। সেখানে ছিল কালো আদা, কালো হলুদ, নীল রঙের হলুদ , লাল রঙের কচু প্রভৃতি নানান দুষ্প্রাপ্য ওষধী গুন সম্পন্ন সুস্বাদু কন্দ। পশ্চিম বঙ্গ থেকে যারা গিয়েছিল তাদের ষ্টলে ছিল বহু রকমের ধানবীজ, গম, নানান তুলা, মিলেট ও সব্জীর বীজ।
বিটি কটনের বিরুদ্ধে আমরা অনেক লিখেছি। অনেক পোষ্টার লাগিয়েছি সেমিনার করেছি। কিন্তু এখানে তুলা বলে একটি সংগঠনের সাথে আলাপ হল যারা দেশীয় তুলাবীজ সংরক্ষণ করেছে। চাষীদের সংগঠিত করে সেই তুলোচাষ করিয়েছে। চরকায় সেই তুলো কেটে সুতো করেছে। তাঁতিদের সংগঠিত করে কাপড় বুনিয়েছে এবং আরামদায়ক পিওর কটনের জামা কুর্তি কামিজ বিক্রি করছে। কাপড়ের রঙ প্রাকৃতিক এমনকি বোতামও নারকেল খোলের তৈরী। তারা চাষী ও তাঁতিদের ন্যায্য দাম দেয়। জীন-সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে যারা লড়তে চান। এই মডেলের কথা ভাবতে পারেন।
Apnar namber