প্রথমেই বলে রাখি এই প্রতিবেদনটিতে আমরা কখনই বলছিনা যে গাছ লাগাবেন না। অসংখ্য বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানকে একসাথে করে লেখা এই প্রবন্ধটিতে আমরা দেখানোর চেষ্টা করছি যে দুই হাজার মাইল দূর থেকে প্রচুর কার্বন এমিশন করে আনা একটা সেভ ট্রি টি-শার্ট পড়ে আপনি গাছ লাগাতে লাগাতে যদি ভাবেন যাক, জলবায়ু পরিবর্তন আটকে দিলাম! সেটা কিন্তু ঠিক হবে না। গাছ লাগান বায়োডাইভারসিটির জন্যে, গাছ লাগান কারণ কাঠ ছাড়াও হাজার একটা জিনিস আমরা গাছ থেকে পাই বলে, গাছ লাগান তার শীতল ছায়ায় জন্য, পাখির ডাকের জন্য, আর রোজগারের উপায় এর জন্য।
ছোটবেলা থেকেই গাছ লাগাও প্রাণ বাঁচাও জাতীয় স্লোগান শুনে বড় হয়ে হঠাৎ করে এরকম একটা প্রশ্ন শুনে মনে হতেই পারে গাছ লাগানো তো সব কিছুর একমাত্র সমাধান। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তন তেমন একটা জটিল জিনিস যে গাছ লাগিয়ে ফেললেই যে এটাকে আটকানো যাবে সেটা সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা যথেষ্ট সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। কিছু বৈজ্ঞানিক আবার এক ধাপ এগিয়ে বলেও ফেলেছেন যে জলবায়ু পরিবর্তন আটকানোর জন্য দয়া করে গাছ লাগাতে যাবেন না। তাহলে কি আমরা ছোটবেলা থেকে যা পড়লাম তা ভুল! চলুন আগে দেখেনি, এই প্রসঙ্গে বিশ্ব বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক জার্নাল গুলিতে প্রকাশিত বিভিন্ন গবেষণার ফলাফলগুলি।
২০১৪ সালে নাদিন ঊঙ্গার নিউইয়র্ক টাইমসে একটি প্রতিবেদন লেখেন যার শিরোনাম পৃথিবী কে বাঁচাতে হলে দয়া করে গাছ লাগাবেন না। এখন প্রশ্ন হচ্ছে নাদিন ঊঙ্গার কি পাগল? মোটেই না, তিনি এক্সটার ইউনিভার্সিটির এক বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক।
তার যুক্তি ফিজিক্সের প্রাথমিক একটা প্রিন্সিপালের উপরে দাঁড়িয়ে। পৃথিবীর উষ্ণতা নির্ভর করে কতটা পরিমাণ সূর্যালোক পৃথিবীতে পড়ছে এবং কতটা ফিরে যাচ্ছে তার ওপরে। এবার যেহেতু গাছ একটি গাড় রং এর বস্তু কাজেই সে সূর্যের শক্তি বেশি শোষণ করবে। ২০০৭ সালের ইউরোপ এবং কানাডার বিজ্ঞানীদের একটি একটি গবেষণা অনুযায়ী নিরক্ষীয় অঞ্চল বা ট্রপিকাল রিজিয়ন হল গাছ লাগাবার জন্য সবথেকে আদর্শ জায়গা। কারণ এখানে কাজ তাড়াতাড়ি বেড়ে ওঠে এবং সবথেকে বেশি কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণ করতে পারে। কিন্তু তারা এটাও দেখিয়েছিলে যে মেরু প্রদেশ গাছ লাগানোর ফলে গ্লোবাল ওয়ার্মিং বিশ্ব উষ্ণায়ন বেড়ে যেতে পারে। তাদের কথার সারমর্ম অনুযায়ী গাছ লাগানো জলবায়ু পরিবর্তন কি আটকাতে সাহায্য করবে কিন্তু যদি সেই গাছ ঠিকঠাক জায়গায় লাগানো হয়। নাদিনের গবেষণা আরো বলছে যে গাছ থেকে ভিওসি নামের একটি গ্যাসিয় কেমিক্যাল বের হয়ে যা কিনা পরবর্তীকালে মিথেন এবং ওজনের মত গ্রীন হাউজ গ্যাস সৃষ্টি করতে সাহায্য করে। ঊঙ্গারের গবেষণাকে আর এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে গেছেন স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির গবেষকরা। তারা বলছেন, গাছ লাগানোর জন্যে সরকারি সাহায্য পাওয়া যায় কিন্তু জঙ্গল বাঁচিয়ে রাখার জন্যে নয়। তাই অনেক জায়গায় গাছের মালিকরা স্থানিয় গাছের বদলে সেই জায়গায় লাভজনক গাছ লাগাতে শুরু করেন।
টিম ট্রি বলে একটি এনজিও ২.১ কোটি গাছ মূলত নিরক্ষীয় অঞ্চলে লাগাতে শুরু করেছে। এক নজরে দেখতে গেলে এই সংখ্যাটা বিশাল বলে মনে হয়। কিন্তু অংকের হিসেবে দেখতে গেলে এই ২.১ কোটি গাছের কার্বন ডাই অক্সাইড বাতাস থেকে কমাবার ক্ষমতা ১০ বছরে ৪০ লক্ষ টন এর কাছাকাছি। শুধুমাত্র ২০১৯ সালে গোটা পৃথিবী থেকে ৪৩.১ বিলিয়ন টন কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গত হয়েছে। এখানে বলে রাখা ভালো এক হাজার মিলিয়নে এক বিলিয়ন হয়। তাহলে বুঝতেই পারছেন এত কোটি গাছ লাগিয়ে আমাদের সৃষ্টি করা কার্বন-ডাই-অক্সাইড কমাবার চেষ্টা করা সমুদ্র থেকে না হলেও দীঘি থেকে এক বালতি জল তোলার মতো। একই সাথে আরেকটা পরিসংখ্যান দি, ২০১৯ সালে অ্যামাজন ওয়াইল্ডফায়ার ১০০০ মিলিয়ন গাছ পুড়ে মারা গেছে। আরো শুনবেন ২০২০ তে অস্ট্রেলিয়ান বুশফায়ার এ ১০০০০ মিলিয়ন গাছ পুড়ে মারা গেছে। ডিফরেস্টেশন বা গাছ কাটা (এবং জঙ্গলে আগুন) যদি আটকানো যায় সে ক্ষেত্রে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ ১০ শতাংশ কমে যাবে। আমরা গাছ লাগিয়ে যতটুকু পোকার করার চেষ্টা করছি তার থেকে অনেক বেশি পরিমান ক্ষতি হচ্ছে যে গাছগুলি এখন বেঁচে আছে তাদেরকে রক্ষা না করায়।
ষাট সত্তর ও আশির দশকে যখন বিশ্বজুড়ে প্রবল পরিমাণে গাছ লাগাবার একটা আন্দোলন চলছিল, তখন দেখা গেছে বেশিরভাগ জায়গাতেই এক বিশেষ প্রজাতির গাছি প্রচুর পরিমাণে লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। যেমন ইউরোপ জুড়ে এক বিশেষ প্রজাতির কনিফার বা ঝাউ জাতীয় গাছ লাগিয়ে ফেলা হয়েছিল। ইউরোপ ছাড়ুন, হাতের কাছে উদাহরণ আছে। গোটা বাংলা জুড়ে লাগানো হয়েছে ইউক্যালিপটাস, তারও আগে ব্রিটিশরা গোটা দার্জিলিং জুড়ে জাপানি সিডার বা ঝুপি গাছ লাগিয়ে গেছিল। কোনটিরই কিন্তু বর্তমান ফলাফল ভালো হয়নি। মনোকালচার বা একই রকমের গাছ লাগানো পরিবেশের জন্য অত্যন্ত খারাপ খবর নিয়ে আসতে পারে। এবং এটা পরীক্ষিত সত্য যে মনোকালচার ফরেস্ট কখনোই বায়োডাইভারসিটি-বান্ধব নয়।
মোটামুটি দেখা গেছে যে, চারাগাছ জলের অভাব বা পোকামাকড়ের আক্রমণ ইত্যাদির ফলে বেঁচে থাকার হার মাত্র ২৫%। অর্থাৎ কিনা চারটে গাছ যদি আপনি লাগান সে ক্ষেত্রে হয়তো একটা গাছ পূর্ণবয়স্ক হয়ে উঠবে। এই পূর্ণবয়স্ক গাছ, বৃক্ষরোপণের ১৫ থেকে ৩০ বছর পরে বাতাস থেকে যথেষ্ট পরিমাণ কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করতে পারে। অর্থাৎ আপনি যদি কার্বন-ডাই-অক্সাইড কমাবার জন্য গাছ আজকে লাগান তাহলে তার কার্যকরী হতে হতে কিন্তু প্রায় তিন দশক অব্দি লাগতে পারে। গাছ ততক্ষণ অব্দি কার্বন-ডাই-অক্সাইডকে শোষণ করে রাখতে পারে যতক্ষণ অব্দি সে জীবিত আছে। গাছের মৃত্যুর পরে কিন্তু আণুবীক্ষণিক জীবেরা গাছের কাঠে সঞ্জিত কার্বন-ডাই-অক্সাইডকে আবার বাতাসে ফিরিয়ে দেয়।
তার মানে খানিকটা এরকম যে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়তে গেলে নতুন গাছ লাগাবার আগে পুরনো গাছগুলিকে বা জঙ্গল গুলিকে যথাযথভাবে সংরক্ষণ করার দরকার। আর তাহলে গাছ লাগাব কেন আমরা? কারণ গাছের সাথে জড়িয়ে আছে বাস্তুতন্ত্র, গাছের সাথে জড়িয়ে থাকে আমাদের জীবিকা, ভূমিক্ষয় রোধ করে গাছ, আরবান হিট আইল্যান্ড বা শহরের উষ্ণ দ্বীপপুঞ্জ গুলি থেকে মানুষকে রক্ষা করে গাছ, কাঠ ছাড়াও হাজার একটা প্রডাক্ট বা বিক্রয়যোগ্য সামগ্রী গাছ থেকে আমরা পেতে পারি। অনেক সময়ই নতুন এক হাজারটা গাছ লাগান অজুহাতে পুরনো দশটি গাছ কেটে বিভিন্ন প্রকল্প বাড়ি রাস্তাঘাট ইত্যাদি হয়। আমাদের একটা জিনিস বুঝতে হবে যে জলবায়ু পরিবর্তনের কথা মাথায় রাখলে আমাদের সম্ভবত কুড়ি তিরিশ বছর অপেক্ষা করার মতো সময় নেই। তাই নতুন জঙ্গল বসানোর প্রতিশ্রুতিতে পুরনো জঙ্গল কেটে ফেলা বৈজ্ঞানিকভাবে কাম্য নয়।
পরিশেষে, আমাদের এটা মাথায় রাখতে হবে যে গাছ জলবায়ু পরিবর্তনের হার অল্প কমাতে পারে কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তন বন্ধ করতে পারেনা। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধের জন্য আমাদের বর্তমান অরণ্য গুলির রক্ষণাবেক্ষণ এবং সংরক্ষণ সর্বাগ্রে প্রয়োজন। গাছ লাগানো কিন্তু অনেক সময় বিপদজনক হয়ে যেতে পারে, কাজেই বনসৃজন প্রকল্পের কি ধরনের গাছ লাগাবেন তা জানতে চোখ রাখুন সবুজ পৃথিবীর ওয়েবসাইটে।
আরো পড়ুন :
ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কি ভাবছে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে? পর্ব ২