টুলকিট

গাছ নয় জঙ্গল লাগান: মিয়াওয়াকি পদ্ধতি ব্যবহার করুন

গাছ নয় জঙ্গল লাগান: মিয়াওয়াকি পদ্ধতি ব্যবহার করুন

মিয়াওয়াকি পদ্ধতি জাপানের বিখ্যাত বোটানিস্ট আকিরা মিয়াওয়াকি প্রবর্তন করেন। এই পদ্ধতিতে অত্যন্ত দ্রুত ঘন জঙ্গল বানানো সম্ভব হয়েছে এবং সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হল তিন বছরের পরে এই জঙ্গল গুলি কোনরকম রক্ষণাবেক্ষণের প্রয়োজন হয় না।

মিয়াওয়াকি পদ্ধতিতে অত্যন্ত ছোট জায়গাতেও (৩০ বর্গ ফুট) ঘন জঙ্গল বানানো সম্ভব। ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে এই পদ্ধতিতে বিভিন্ন আকারের জঙ্গল বানানো হচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গের হাওড়াতেও সম্প্রতি এই পদ্ধতিতে জঙ্গল বানানো হয়েছে এবং তার নাম বিখ্যাত জলবায়ুযোদ্ধা গ্রেটা থুনবার্গ এর নামে রাখা হয়েছে। এই পদ্ধতিতে জঙ্গল বানানোর প্রক্রিয়ার যাবতীয় তথ্যাবলী নিচে আলোচনা করা হলো।

 মাটির পরীক্ষা

এই পদ্ধতিতে সবার আগে যে অঞ্চলে জঙ্গল সৃষ্টি করা হবে সে খানের মাটির জল ধারণ ক্ষমতা, মাটির ধরন, জৈব বস্তুর পরিমাণ ইত্যাদি সম্পর্কে কিছু তথ্য জানার প্রয়োজন আছে। প্রথমে একমুঠো মাটি নিয়ে তাতে সামান্য জল মিশিয়ে দলা পাকাতে থাকুন, জল বা মাটির পরিমাণ বাড়িয়ে কমিয়ে একটা গোল বল করার চেষ্টা করুন (অনেকটা রুটির জন্যে আটার বলের মত)। মাটিতে বালির পরিমাণ বেশি থাকলে মাটির বলটি তৈরির সময়ই ভেঙে যাবে। এইবারে এই গোলাকার বলটিকে হাতের চাপে একটি চ্যাপ্টা ফিতের মত করার চেষ্টা করুন। ফি যত লম্বা হবে, ততোই কিন্তু মাটিতে কাদার পরিমাণ বেশি বলে ধরে নেওয়া হয়। দোআঁশ মাটি হল আদর্শ, বেলে বা এঁটেল মাটির ক্ষেত্রে মাটিতে সামান্য কিছু উপকরণ দেওয়ার প্রয়োজন আছে। বালির ভাগ বেশি যে মাটিতে সেখানে জলের ধারণ ক্ষমতা বাড়াতে হবে।

miyawaki forest - Soil

১০০০ স্কোয়ার ফুট অঞ্চলের জন্যে : ৫০০ কেজি কোকোপিট, ৫০০ কেজি ভার্মি কম্পোস্ট এবং ৫ লিটার জীবামৃত যথেষ্ট।
একই ভাবে এঁটেল মাটির জন্যে মাটিতে জল চলাচল করার ক্ষমতা বাড়াতে হবে। এই জন্যে প্রতি ১০০০ স্কোয়ার ফুট অঞ্চলে ১৫০ কেজি কোকোপিট, ৫০০কেজি ধানের তুষ, ৫০০ কেজি ভার্মি কম্পোস্ট এবং ৫ লিটার জীবামৃত দরকার। জিবামৃত এর তৈরির পদ্ধতির জন্যে এই লেখাটি পড়ুন। অনেক সময়ই দেখা যায় যে বিভিন্ন অঞ্চলের মাটির খারাপ ব্যবহারের কারণে ওপর ভাগের মাটি বা টপ সয়েল একেবারে শক্ত কাঠ হয়ে গেছে। সেই ক্ষেত্রে সবথেকে ভালো উপায় হল মোটামুটি ১০ থেকে ১৪ ইঞ্চি মাটি উপর থেকে সরিয়ে দিয়ে সেখানে নতুন মাটি ফেলা। রিবন টেস্টের সম্পর্কে আরো জানতে এই ভিডিওটিতে ক্লিক করুন।

তাহলে সহজ ভাষায় বলতে গেলে মাটির উর্বরতা বাড়ানোর জন্য আমাদের এমন জৈব বস্তু যোগ করতে হবে যা মাটির জল ধারণ ক্ষমতা এবং মাটির মধ্যে বাতাস চলাচলের ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। মাটির মধ্যে বাতাস চলাচল বৃদ্ধির জন্য ধান বা গমের তুষ ছাড়াও চিনেবাদামের খোলা ব্যবহার করতে পারেন। জল ধারণ ক্ষমতা বাড়াবার জন্য কোকোপিট বা সমপরিমাণ শুকনো আখের ছিবড়ে ব্যবহার করা যায়। মাটির মধ্যে বিভিন্ন জৈব ও অজৈব খাদ্যের বৃদ্ধির জন্য ভার্মি কম্পোস্ট ছাড়াও গরুর গোবর, ছাগলের বর্জ্য পদার্থ, জীবন্মৃত ইত্যাদি ব্যবহার করতে পারেন। জল ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য মালচিং একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া। মাটি তৈরির পরে গাছ বসানোর সময় অবশ্যই ছয় থেকে আট মাস অব্দি খড় দিয়ে গোটা মাটি ঢেকে রাখুন যাতে সূর্যের তাপে বাষ্পমোচন কম হয় এবং জমিতে বন্ধুপোকা এবং অনুজীব বাড়ার সুযোগ পায়।

 

গাছ চয়ন

মিয়াওয়াকি পদ্ধতিতে করা জঙ্গলের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হলো সঠিক গাছ চয়ন করা। এর জন্য সবার আগে আপনার অঞ্চলের স্বাভাবিক যে গাছপালা সেই গুলিকে বাছুন। ৫০ থেকে ১০০ কিলোমিটারের মধ্যে যদি স্বাভাবিক অরণ্য থাকে তাহলে সেই অরন্যের গাছগুলির একটি লিস্ট করে নিতে পারেন। এই পদ্ধতিতে আপনি ত্রিশটি বা তার অধিক ধরনের গাছ ঘনভাবে লাগাতে পারেন। কাছাকাছি জঙ্গল না থাকলে, অঞ্চলের বৃদ্ধ বৃদ্ধাদের জিজ্ঞাসা করুন তাদের যৌবনকালের গাছের সম্পর্কে। গাছ বিশেষজ্ঞ বা জঙ্গল বিশেষজ্ঞের সাথে ও অতি অবশ্যই পরামর্শ করুন। পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মাটি এবং জলবায়ু বিভিন্ন হওয়ার কারণে নেটিভ গাছ বা স্থানীয় গাছের তারতম্য হয়। রাঢ় অঞ্চলে বর্তমানে অত্যাধিক ভাবে ইউক্যালিপটাস দেখা গেলেও এই গাছ কিন্তু রাঢ় অঞ্চলের নিজস্ব গাছ নয়। কাজেই আমাদের অত্যন্ত সচেতন ভাবে গাছের প্রজাতি নির্বাচন করতে হবে যাতে স্থানীয় ছাড়া অন্য কোনো রকমের গাছ প্রাধান্য না পায়। গাছের বীজ সংগ্রহ করে নিজে থেকে নার্সারি করতে পারেন অথবা স্থানীয় দোকান থেকেও ৬০ থেকে ৮০ সেন্টিমিটার (২ফুট) উচ্চতার গাছ কিনতে পারেন। একটি জঙ্গলের বিভিন্ন উচ্চতায় গাছ পাওয়া যায়। জঙ্গলের জমিতে যে রকম ঝোপ জাতীয় গাছ পাওয়া যায় তেমনি বৃক্ষজাতীয় উঁচু গাছ ও পাওয়া যায়। অর্ধেক বৃক্ষজাতীয় উঁচু গাছ হলে, সিকি ভাগ ঝোপ জাতীয় গাছ এবং সিকিভাগ মাঝামাঝি উচ্চতার গাছ নির্বাচন করুন। স্রাব, সাব ট্রি, ট্রি এবং ক্যানোপি এই চার ধরনেরই গাছ আপনার জঙ্গলে লাগানোর দরকার।

miyawaki forest

 জঙ্গলের গঠন

সবার আগে যে জায়গাতে জঙ্গল বানাবার ইচ্ছে সেই জায়গাটি ঠিক করুন এবং তার চারিদিকে রেখা দিয়ে চিহ্নিত করে দিন। জঙ্গলের প্রস্থ অন্তত ৪ মিটার বা তার বেশি হওয়া বাঞ্ছনীয়। এরপরে জঙ্গলের জল দেওয়ার জন্য পাইপলাইনের নকশা করে নিন। প্রথম দু’বছর থেকে তিন বছর এই জঙ্গলটিতে জল দেওয়ার প্রয়োজন আছে, তারপরে এই জঙ্গল স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠবে। বর্ষাকাল ছাড়া যেকোনো সময়ই আপনারা এই পদ্ধতিতে জঙ্গল লাগানো শুরু করতে পারেন।

miyawaki forest - arch

অঞ্চল তৈরি

যে অঞ্চলে জঙ্গল তৈরি করবেন বলে ঠিক করেছেন সেখানে যেন দিনের আট থেকে নয় ঘণ্টা সূর্যালোক থাকে, এবং জঙ্গলের কাছাকাছি যেন কোনো রকমের নালা বা আবর্জনা ফেলার অঞ্চল না থাকে। প্রথমেই মাটি থেকে আগাছা এবং আবর্জনা সমস্ত উপরে ফেলুন। এই কাজ আপনারা ট্রাকটার দিয়েও করতে পারেন আবার যদি সম্মিলিতভাবে করেন তাহলে হাতে হাতেও করতে পারেন। আগাছা তুলে সেগুলিকে একটি দূরের অঞ্চলে ফেলে দিয়ে আসুন। জলের জন্য ড্রিপ ইরিগেশন বা স্প্রিংকলার ব্যবহার না করে হোস পাইপ বা হাতে করে জল ছেঁটানোর যন্ত্র ব্যবহার করুন। দিনে মোটামুটি পাঁচ লিটার প্রতি বর্গফুটে জল লাগবে। বর্ষার সময় ছাড়া দিনে একবার বা দু’বার ভোর বেলায় এবং বিকেল বেলায় জল দেওয়া দরকার। গৃহপালিত পশুর আনাগোনা থাকলে অঞ্চলটিকে অবশ্যই কাঁটাঝোপ দিয়ে ঘিরে ফেলুন।

 

বৃক্ষরোপণ

বৃক্ষরোপনের দিন সমস্ত মাটির উপাদান (ধানের তুষ, ভার্মি কম্পোস্ট ইত্যাদি) একসাথে মিশিয়ে নিন। এইবারে একটি আর্থ মুভার বা জেসিবি জাতীয় যন্ত্র দিয়ে এলাকাটির মাটির ১ মিটার গভীরতা অব্দি খনন করুন। খনন করার পরে অর্ধেক মাটি ঝুরি ঝুরি করে আবার সমানভাবে ওই অঞ্চলে মিশিয়ে দিন। এতে মাটির মধ্যে জল বাতাস ঢোকার সুযোগ পাবে। বাকি অর্ধেক মাটির সাথে ধানের তুষ, ভার্মি কম্পোস্ট ইত্যাদিতে একসাথে মিশিয়ে সমানভাবে ছড়িয়ে দিন। এর উপরে জীবন্মৃত ঢেলে দিন। সাধারণ পদ্ধতি তুলনায় মিয়াওয়াকি পদ্ধতিতে একটি একটি করে গর্ত খনন করে গাছ না লাগিয়ে সম্পূর্ণ অঞ্চলেরই মাটি খনন করে তারপরে গাছ লাগানো হয়। সম্পূর্ণ অঞ্চলের খনন এবং সার মেশানো হয়ে গেলে, গাছের চারা গুলি একটি ১ ফুট লম্বা এবং ১ ফুট চওড়া গর্ত করে লাগিয়ে দিন। গাছের চারাগুলি লাগানোর সময় খেয়াল রাখবেন যাতে দুটি একই লেয়ারের গাছ পাশাপাশি না থাকে, অর্থাৎ দুটি স্রাব বা দুটি ট্রি যেন পাশাপাশি না থাকে। পুরো অঞ্চলটিকে প্রথমেই একাধিক স্কয়ার বা বক্সে ভাগ করে নিন এবং প্রত্যেক স্কয়ার মিটার এই যেন এই চারটি ভাগের বা লেয়ারের গাছ থাকে (স্রাব, সাব ট্রি, ট্রি এবং ক্যানোপী)। গাছ গুলির মধ্যে যেন দেড় থেকে দুই ফুটের দূরত্ব থাকে। এবং চেষ্টা করুন যাতে একটা ত্রিভুজ আকৃতির ফরমেশনে গাছগুলি লাগানো হয়। এতে জঙ্গল আরো ঘন হবে।

miyawaki forest - planting trees

একবার জমি তৈরী হয়ে গেলে চেষ্টা করবেন যত সম্ভব কম জমির উপরে চলাচল করার, বেশি চলাচল করলে জমি কিন্তু শক্ত হয়ে যাবে। কাজেই জল দেওয়া এবং গাছ পোঁতার সময় যত অল্প পরিমাণ মানুষ জমির উপরে চলাচল করে ততোই ভালো। প্রত্যেকটি গাছের সাথেই একটি করে বাঁশের কঞ্চি দিয়ে গাছগুলিকে সাপোর্ট দিন। গাছ পোঁতা হয়ে গেলে পুরো অঞ্চলটিতে ভালোভাবে শুকনো খড় দিয়ে মালচিং করে দিন বা ঢেকে দিন। মোটামুটি আধ ফুটের মতো শুকনো খড়ের স্তর দেওয়া ভালো। খেয়াল রাখবেন যেন শুকনো খড় উড়ে না যায়, দরকার হলে এই খড়ের ওপরে দড়ি দিয়ে আটকে রাখুন।

miyawaki forest - watrering plan

পরিচর্যা

প্রতিদিন জল দেওয়া ছাড়া প্রতি এক মাস অন্তর এই জঙ্গলের প্লটটিতে আগাছা হচ্ছে কিনা, গাছের গ্রোথ কিরকম, গাছ মারা যাচ্ছে কিনা ইত্যাদি দেখতে হবে। প্রথম বছর খানেক অন্তত মাসে একবার করে জঙ্গল দিতে ভালোভাবে পরিচর্যা করা দরকার। গাছগুলি সোজা বাড়ছে কিনা এবং আরো লম্বা সাপোর্ট এর দরকার আছে কিনা সেই বিষয়ে খেয়াল রাখা দরকার। কোন রকমের আবর্জনা যেন জঙ্গলে না আসে। এবং অবশ্যই জঙ্গলটিতে কোন ভাবে যেন জল না জমতে পারে। ১০০টি গাছের মধ্যে ৯৫ টি গাছ যদি বাঁচে তাহলে জানবেন আপনার পরিশ্রম বৃথা যায়নি। বছরে একবার অন্তত খড়ের মালচিং করবেন প্রথম দুই থেকে তিন বছর অব্দি। গাছের ডাল কোনোভাবেই কাটবেন না এবং কোনভাবেই অজৈব পেস্টিসাইড বা সার দেবেন না।

miyawaki forest - watrering plan

প্রথম দুই থেকে তিন বছর রক্ষণাবেক্ষণের পর থেকে এই জঙ্গল স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠবে এবং তারপরে কোনরকম পরিচর্যার প্রয়োজন পড়বে না। একটি ৬০০ স্কয়ার ফিট জঙ্গল তৈরি করতে ভারতীয় মুদ্রায় মোটামুটি ১৫ থেকে ২৫ হাজার টাকার খরচা হয়। এই খরচা ১০০ দিনের কাজের মধ্যে ঢুকিয়ে বা কমিউনিটিতে একসাথে কাজ করলে অনেকটাই কমাতে পারেন। শহরের মধ্যে খুব ছোট ছোট জায়গাতেই এই জঙ্গল তৈরি করা সম্ভব। এই ধরনের জঙ্গল শহরের মধ্যে উষ্ণ দ্বীপপুঞ্জ বা আরবান হিট আইল্যান্ডের প্রভাব কমাতে দারুন ভাবে সাহায্য করবে। আর গ্রামাঞ্চলে এই জঙ্গল সরাসরি মানুষের জীবন-জীবিকার সাথে যুক্ত হতে পারে।

Leave a Comment