প্রতিবেদন

ভূগর্ভস্থ জল সঞ্চয় ও সংরক্ষণের উপায়

ভূগর্ভস্থ জল সঞ্চয় ও সংরক্ষণের উপায়

কলমেঃ

তরুন সরকার, বিষয়বস্তু বিশেষজ্ঞ (শস্যবিজ্ঞান), পূর্ব মেদিনীপুর কৃষিবিজ্ঞান কেন্দ্র

চৌধুরী নাজমুল হক, গবেষক, কৃষি সম্প্রসারন বিভাগ, বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ব বিদ্যালয়

—————————————————————————————————————

রাস্তার কল থেকে জল পড়ে গেছে, বন্ধ করিনি। বাসন ধোয়া থেকে স্নান, জল নষ্ট করেছি অকাতরে। ফুরিয়ে আসছে মাটির তলার জলের ভান্ডার। জল সংরক্ষণ ও সঞ্চয় নিয়ে না ভাবলে সমূহ বিপদ। এ বড় সুখের সময় নয়। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে শরশয্যায় শায়িত ভীষ্মের তেষ্টা মেটাতে অর্জুন ভূমিতে তির ছুড়ে তাৎক্ষণিক ফোয়ারা সৃষ্টি করেছিলেন। কিন্তু ভূগর্ভের জলতল গত কয়েক দশকে এতই নীচে নেমে গেছে, যে গোটাকতক তির ছুঁড়েও তার নাগাল পাওয়া এখন প্রায় অসম্ভব। সেও অবশ্য আমরা জানতে পেরেছি কিছু দিন মাত্র। গত বছর  চেন্নাইয়ের জলসঙ্কট, নীতি আয়োগের রিপোর্ট ইত্যাদির সূত্র ধরে হঠাৎই আমাদের চোখকান খুলে গেছে। আমাদের অভিধানে ঢুকে গেছে ‘অ্যাকুইফার’, ‘ওয়াটার টেবল’, ‘ওয়াটার ফুটপ্রিন্ট’, ‘ওয়াটার-মার্কেট’, এমনকি ‘ওয়াটার মাফিয়া’র মতো শব্দও। আমরা জানতে পেরেছি, ২০৪০-৫০ সালের মধ্যে ‘সুজলাং’ ভারতবর্ষ জলশূন্য হয়ে যেতে পারে।

বর্তমান এই কোভিড-১৯ মহামারির আবহে জল সংকটতা এই বিষয়টি সকলের নজর এড়িয়ে আবার মাথা চারা দিতে শুরু করেছে। বিগত প্রতিবেদনে জল সংরক্ষণের গুরুত্বের দিকে আমরা আলোকপাত করেছিলাম, এই প্রতিবেদনে আলোচনা করবো জল সংরক্ষণের উপায় গুলি সম্বন্ধে।

 

ভূগর্ভস্থ জল বলতে কি ?

হিমশৈল থেকে সৃষ্ট নদীগুলোয় না হয় সারা বছর কিছু না কিছু বরফ-গলা জল এসেই যায়, কিন্তু অন্যান্য নদীগুলোয় (যেমন দক্ষিণ ভারতের নর্মদা-কৃষ্ণা-কাবেরী) আর পুকুর-খাল-বিলে জল আসে কোথা থেকে, অবশ্যই বৃষ্টি থেকে। মাটির ঠিক নীচে থাকে ভূগর্ভস্থ জলের একটা স্তর, যাকে বলা হয় ‘ওয়াটার টেবল’ বা ‘জলতল’। মূলত বৃষ্টির জল জমে তৈরি এই জলতল আমাদের বিভিন্ন জলাশয়ে জলের জোগান দেয়। এর নীচে থাকে ভূগর্ভস্থ জলের সম্ভার (অ্যাকুইফার), যা কোথাও জলতলের কাছাকাছি আবার কোথাও মাটির অনেক গভীরে প্রায় বিচ্ছিন্ন অবস্থায় থাকে। ভূতলে উন্মুক্ত যে জলভান্ডার (নদী, পুকুর) সেখান থেকে যেমন জল তুলে নেওয়া হয়, জল বাষ্প হয়ে যায় (ডিসচার্জ), তেমনই বৃষ্টির সময় সেই জলভান্ডার ফের পূর্ণ হয়ে ওঠে (রিচার্জ)। বৃষ্টির জল চুঁইয়ে ঢুকে জলতল অবধিও সহজেই পৌঁছে যায়। সুতরাং এই জলতলের জলের সম্ভার অফুরন্ত না হলেও পুনর্নবীকরণযোগ্য।

জল সঞ্চয় ও সংরক্ষণের উপায় ৫

ভূগর্ভস্থ জলের পরিমান ক্রম হ্রাস মান হওয়ার কারন কি? 

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে জনসংখ্যা বেড়েছে, জীবনযাপনের পরিবর্তন হয়েছে, কৃষি ও শিল্পের উন্নতি হয়েছে। সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তৈরি হয়েছে জলের হাজার রকম প্রয়োজনীয়তা। চাহিদাও বেড়েছে। বাড়তি দরকার মেটাতে হাত পড়েছে ভূগর্ভস্থ জলের ভান্ডারে। পাম্পের সাহায্যে জল তুলে নেওয়া হয়েছে ওয়াটার টেব্‌ল এবং অ্যাকুইফার থেকে। মোটামুটি ১৯৫০ সাল থেকে এই প্রবণতা এতই বেড়েছে যে আমরা অনেকে জানিই না, আমাদের মোট পানীয় জলের ৫০%, শিল্পের জন্য দরকারি জলের ৪০% আর সেচের জলের ২০% এখন আসছে ভূগর্ভস্থ আধার থেকে। এই অতিমাত্রায় নিষ্কাশনের জন্য ওয়াটার টেবল বিপজ্জনক ভাবে নেমে যাচ্ছে। বৃষ্টিপাতে জলস্তরের যে স্বাভাবিক রিচার্জ হয়, নিষ্কাশনের হার তার থেকে অনেকটা বেশি হয়ে পড়েছে। এমনিতে ওয়াটার টেব্‌লের নীচের মাটি জলে সম্পৃক্ত হলে সেই জল চুঁইয়ে ভূগর্ভস্থ জলভান্ডার অবধি পৌঁছে তাকেও রিচার্জ করতে পারে। কিন্তু যে ওয়াটার টেব্‌লের নীচে কাদামাটি বা শক্ত পাথরের স্তর থাকে সেখান থেকে জল চুঁইয়ে অ্যাকুইফার অবধি পৌঁছয় না; সেখানে জলের সম্ভার বেশি হয়ে গেলে তা পাশাপাশি গড়িয়ে সমুদ্রে চলে যায়। দক্ষিণবঙ্গে এই রকম অঞ্চল আছে বেশ কিছু। বছর কয়েক আগে বর্ষার শুরুতে দু-তিন দিন টানা বৃষ্টির বিপুল জল সমুদ্রে চলে গিয়েছিল। তাই এই রকম ওয়াটার টেবলের নীচে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় থাকে যে অ্যাকুইফার, তা থেকে পাম্প চালিয়ে জল তুলে নিলে স্বাভাবিক ভাবে সেই জল সব সময় রিচার্জ হয় না। কিন্তু গভীর নলকূপ বসিয়ে জল তুলে নেওয়ার সময় কেই বা এ সব বিচার করে! ব্যবহারের পর এই মিষ্টি জল সরাসরি অ্যাকুইফারে ফিরতে পারছে না। মিশছে সমুদ্রের নোনা জলের সঙ্গে, তার পর বাষ্প-মেঘ-বৃষ্টি চক্রের মধ্যে দিয়ে মাটিতে ফিরে এলেও তা সব সময় ভূগর্ভে পৌঁছচ্ছে না। আর এ ভাবেই খালি হয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন অঞ্চলের মাটির নীচের জল। কুয়োর জল নেমে যাচ্ছে, শুকিয়ে যাচ্ছে পুকুর, খাল, নদীও। তার সরাসরি প্রভাব পড়ছে পরিবেশে। ২০১৫ সালে নাসা-র ‘গ্র্যাভিটি রিকভারি অ্যান্ড ক্লাইমেট এক্সপেরিমেন্ট’ (গ্রেস) উপগ্রহের পাঠানো তথ্যে দেখা গেছে, বেলাগাম অপব্যবহারের ফলে যে কয়েকটি দেশের ভূগর্ভস্থ জল দ্রুত শেষ হয়ে যাচ্ছে তাদের মধ্যে ভারত বেশ এগিয়ে।

ভূগর্ভস্থ জল সংরক্ষণের উপায়গুলি কি? 

শুধু ভূগর্ভস্থ জলের পুনর্নবীকরণ ও সংরক্ষণই নয় , প্রয়োজন বিকল্প ভাবে জলের ব্যবহার বাড়ান। রাষ্ট্রসংঘের এক পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে যে একজন মানুষের সারাদিনে খাওয়ার জন্য দরকার ৫ লিটার জল , স্যানিটেশনে ২০ লিটার , স্নানের জন্য ১৫ লিটার আর রান্নার জন্য ১০ লিটার । মোট ৫০ লিটারের মত জল একজন মানুষের দৈনিক প্রয়োজন হয় ।পরিসংখ্যান থেকে জানা যায় যে বৃষ্টি হয়ে যে জল মাটিতে পড়ে তার মাত্র ২০ থেকে ২৫ শতাংশ মিষ্টি জল হয়ে থেকে যায় । বাকি জল নদি নালা খাল খাঁড়ি হয়ে সমুদ্রের নোনা জলের সাথে মিশে গিয়ে ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে যায় । বিশেষজ্ঞদের মতে ৬৭৬ বর্গমিটার বাড়ির ছাদের বৃষ্টির জল ধরে রাখতে পারলে তা অন্তত ৪০ জন মানুষের সারা বছরের জলের চাহিদা মেটাতে পারবে। ভূগর্ভস্থ জলের ব্যবহার যত সম্ভব কমানোর সবচেয়ে ভালো উপায় হল বৃষ্টির জল সংরক্ষনের ব্যবস্থাপনা।

জল সঞ্চয় ও সংরক্ষণের উপায় ৭

কী করে বৃষ্টির জল সংরক্ষণ করবেনঃ

 বৃষ্টির জল সংরক্ষণ করার যে কোনও ব্য‌বস্থার তিনটি দিক রয়েছে। জল ধরা, জল বহন করা ও জল সঞ্চয় করা। বৃষ্টির জল সংরক্ষণের দু’ধরনের ব্য‌বস্থা আছে।

ক. বাড়ির কাজের প্রয়োজনে ছাদ থেকে বৃষ্টির জল সংগ্রহ করার ব্যবস্থা

খ. কৃষিতে বাড়তি সেচের জন্য মাঠে বা কাছাকাছি জায়গায় জল ধরে রাখার ব্যবস্থা।

জল সঞ্চয় ও সংরক্ষণের উপায় ৬

 

বৃষ্টির জল সংরক্ষণ ব্যবস্থার ছ’টি মৌলিক উপাদান:

১.ক্যাচমেন্ট: ছাদ বা যেখানে জল ধরার ব্যবস্থা।

২.পরিবহন: ছাদ বা জল ধরা হয় সেখান থেকে মজুত করার জায়গায় জল নিয়ে যাওয়ার জন্য চ্যানেল বা পাইপ।

৩.ছাদ বা জল ধরার জায়গা পরিষ্কার করা : যাতে বৃষ্টির জলের সঙ্গে নোংরা না থাকে তার জন্য‌ জল ফিল্টার করতে ‘ফার্স্ট ফ্লাশ ডাইভার্টার’ ব্য‌বস্থা

৪.জল সঞ্চয়: কীটমুক্ত ট্য‌াঙ্ক বা সিস্টার্ন যেখানে জল সংরক্ষণ করে রাখা যাবে।

৫.পরিশ্রুত করা : ফিল্টার করা, ওজোন ও ইউভি আলোর ব্য‌বহার যাতে সংগৃহীত বৃষ্টির জল পানীয় হিসাবে ব্য‌বহার করা যায়।

বৃষ্টির জল সংগ্রহের ক্ষেত্রে যে যে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে –

১. ছাদ সবসময় পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে ।

২. যে নলের মধ্যে দিয়ে মধ্যে দিয়ে জল আসবে তার মুখে ছাঁকনি ব্যবহার করতে হবে ,এর ফলে জলকে ধুলো, বালি বা অন্যান্য ময়লার হাত থেকে মুক্ত করা যায় ।

৩. সংগৃহীত জলকে কয়েকদিন সঞ্চয় করে রাখলে ধুলো বালি থিতিয়ে যায় ।

৪. যে জায়গায় জল ধরা হবে তা চিনামাটির বা পাথরেরে টালি দিয়ে বাঁধিয়ে দিতে হবে কারন এরা ক্ষয়রোধক এবং সহজে পরিস্কার করা যায় ।

৫. সঞ্চিত জলকে যতটা সম্ভব জীবাণু মুক্ত করে বিভিন্ন উপায়ে ভুগর্ভে পাঠাতে হবে ।

৬. রাসায়নিক,পারমানবিক বা জৈব কারখানার আশেপাশে বৃষ্টির জল সংগ্রহের ক্ষেত্রে চূড়ান্ত সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে যাতে এই সব কারখানার বর্জ্য পদার্থ বা বিষাক্ত রাসায়নিক কোনভাবে সঞ্চিত জলকে দূষিত করতে না পারে ।

জল সঞ্চয় ও সংরক্ষণের উপায় ১৫

কৃষিক্ষেত্রে ভূগর্ভস্থ জল সংরক্ষণ ও সঞ্চয়ের উপায়ঃ

দেশে ব্যবহৃত জলের ৭০ শতাংশই খরচ হয় কৃষিক্ষেত্রে, জল সংকট দেখা দিলে সবচেয়ে ক্ষতির মুখে পড়বে এই ক্ষেত্রই। তাই ভাববার সময় এসেছে কিভাবে কৃষিক্ষেত্রে ভূগর্ভস্থ জলের অপচয় যথাসম্ভব কমিয়ে জল সংরক্ষণ করা যায় এবং তা সম্ভব বিভিন্ন কৃষি প্রযুক্তির দ্বারাই,তার মধ্যে অন্যতম হল উন্নত বৈজ্ঞানিক প্রথায় জলসেচ। বর্তমানে কৃষিক্ষেত্রে প্রচলিত বিভিন্ন জলসেচ পদ্ধতিগুলির মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হল-  (১) কুপ ও নলকূপ (২) পুকুর ও জলাশয় এবং (৩) সেচখাল

(১) কুপ ও নলকূপ [Wells and Tube-wells]:- ভারতের যেসব অঞ্চলে ভৌম জলের প্রাচুর্য বেশি, অর্থাৎ যে সব অঞ্চলে বৃষ্টির জল পাললিক শিলাস্তর ভেদ করে মাটির নিচে জমা হতে পারে, সাধারণত সেইসব অঞ্চলে কুপ ও নলকুপের সাহায্যে জল সেচ করা হয়ে থাকে। উত্তর ও পূর্ব ভারতের বিহার, উত্তরপ্রদেশ, পাঞ্জাব, হরিয়ানা, অসম, পশ্চিমবঙ্গ প্রভৃতি রাজ্যে কুপ ও নলকূপের সাহায্যে জল সেচ করা হয়ে থাকে ।

জল সঞ্চয় ও সংরক্ষণের উপায় ১০

(২) পুকুর ও জলাশয় [Ponds and Lakes] বর্ষাকালে বৃষ্টির জল প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম জলাধার অথবা পুকুরে সঞ্চয় করে রেখে সেচের কাজে লাগানো হয় । পাথুরে ভূমি এবং কঠিন ও অপ্রবেশ্য শিলায় গঠিত দাক্ষিণাত্য মালভূমির অপ্রবেশ্য শিলাস্তর ভেদ করে বৃষ্টির জল মাটির নিচে সঞ্চিত হতে পারে না, তাই দক্ষিণ ভারতের তামিলনাড়ু, অন্ধ্রপ্রদেশ, কর্ণাটক রাজ্যের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে পুকুর বা জলাশয় তৈরি করে তা থেকে সেচ করা হয় ।

(৩) সেচ খাল [Irrigation Canal]:- প্রধানত নদনদী বহুল অঞ্চলে সেচখালের সাহায্যে জল সেচ করা হয় । সাধারণত সেচখাল গুলো দু-রকমের হয়, যেমন— (ক) নিত্যবহ খাল ও (খ) প্লাবন খাল ।

(ক) নিত্যবহ খাল:- সারাবছর জল থাকে এমন নদী থেকে কাটা খালকে নিত্যবহ খাল বলে । নদিতে বাঁধ দিয়ে জল উঁচু করে রাখবার ফলে নিত্যবহ খালে সারা বছর জল থাকে । আর এই জল সেচের কাজে লাগানো হয় । পাঞ্জাব, রাজস্থান, উত্তরপ্রদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে প্রধানত নিত্যবহ খালের সাহায্যে জল সেচ করা হয় ।

(খ) প্লাবন খাল:- প্লাবন খাল সাধারণত বর্ষার প্লাবনে জল পূর্ণ হয় । তামিলনাড়ু, অন্ধ্রপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, ওড়িশা ও পশ্চিমবঙ্গে অনেক প্লাবন খাল দেখা যায় ।

ভূপৃষ্ঠ সেচঃ (Surface Irrigation)

   

প্লাবন পদ্ধতি

         জল সঞ্চয় ও সংরক্ষণের উপায় ৫ 

জল সঞ্চয় ও সংরক্ষণের উপায় ৬

কৃষিক্ষেত্রে জল সংরক্ষণের পদ্ধতিঃ

কৃষি জমিতে জল সঞ্চয়ের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উপায় হলো ক্ষুদ্র সেচ প্রযুক্তি।

ক্ষুদ্র সেচ প্রযুক্তিঃ যে পদ্ধতিতে একটি নিম্ম প্রেশারযুক্ত সরবরাহ তন্ত্রের (low pressure delivery system) মাধ্যমে ঘন ঘন বিরতিতে, অনেকক্ষণ ধরে, অল্প অপ্ল পরিমাণে জল সরাসরি গাছের শিকড় অঞ্চলে পৌঁছে দেওয়া হয় তাকেই ক্ষুদ্র সেচ বলে।

ক্ষুদ্র সেচের প্রকারভেদ:

 ১) ওভারহেড বা বর্ষণ সেচ (Overhead/Sprinkler irrigation) ঃ এ পদ্ধতি প্রাকৃতিক বৃষ্টির মতই গাছের উপরে বা জমির উপরে জল বর্ষণ বা সিঞ্চন করা হয়। উঁচু নিচু জমির জন্য এ পদ্ধতি খুবই উপযোগী।

  • ফোয়ারা বা বর্ষণ সেচ (Overhead/Sprinkler irrigation): এ পদ্ধতিতে প্রাকৃতিক বৃষ্টির মতই গাছের উপরে বা জমির উপরে জল বর্ষণ বা সিঞ্চন করা হয়। উঁচুনিচু জমির জন্য এ পদ্ধতি খবুই উপযোগী।
  • একটি স্প্রিক্লার যন্ত্র থেকে ঘণ্টায় ১০০০ লিটার জল বের হয় এবং ২.৫ বারের ও অধিক চাপে মেশিনটি কাজ করে ফলে ১০ মিটারের ও বেশি জায়গাজুড়ে সেচের জল ছড়িয়ে পড়ে। ফোয়ারা বা বর্ষণ সেচ আবার দুই প্রকার যথাঃ

 

জল সঞ্চয় ও সংরক্ষণের উপায় ৩

ফোয়ারা সেচের সুবিধাঃ 

১) সেচের জল পরিবহনের সময় আলাদাভাবে জলের অপচয় হয় না। (জলের অপচয় পৃষ্টসেচে ১৫-২০%, খাল এবং ট্যাংকের মাধ্যমে সেচের ক্ষেত্রে ৩০-৩৫%)।

২) বিভিন্ন ফসলের ক্ষেত্রে এই পদ্ধতিতে জল সাশ্রয় ২৫-৫০% পর্যন্ত।

৩) মাটির কোনরূপ ক্ষয়-ক্ষতি,ধুয়ে যাওয়ার কোন আশংকা থাকে না।

৪) যেসব অঞ্চলে শ্রমিক এবং জলের ঘাটতি রয়েছে সেইসকল জায়গায় প্রযোজ্য।

ফোয়ারা সেচের অসুবিধাঃ 

  1. জোরে বাতাস বইলে ব্যবহার করা যায় না।
  2. প্রারম্ভিক খরচ অনেকটাই বেশি

২) ড্রিপ বা বিন্দু সেচ পদ্ধতিঃ  এই পদ্ধতিতে ছিদ্রযুক্ত নলের সাহায্যে গাছের গোড়ায় ফোটায় ফোটায় সেচ দেওয়া হয় এতে জলের কোন অপচয় হয় না।  একটি ড্রিপার যন্ত্র থেকে ঘণ্টায় ১-৪ লিটার জল বের হয় এবং এক্ষেত্রে স্প্রিক্লার যন্ত্রের মতন কোন বাহ্যিক চাপের দরকার হয় না। বিন্দু সেচের পাইপ লাইনগুলি বিভিন্নভাগে বিভক্ত থাকে; একটি প্রধান পাইপ লাইন, সাব লাইন, শাখা পাইপ লাইন এবং নির্গমন অংশ। নির্গমন অংশের মোট সংখ্যা নির্ভর করে গাছের সংখ্যা এবং তাদের পারস্পারিক দূরত্বের ওপর।

কিছু ফল গাছের জন্য উপযোগী এই সেচ পদ্ধতি উপযোগী যেমন কাঁঠাল, আম, জাম, পেয়ারা, লিচু এবং অধিকাংশ বৃক্ষজাতীয় ফল। নালা আনারস, কলা , পেঁপে, তরমুজ, ফুটি,স্ট্রবেরী ইত্যাদি।

জল সঞ্চয় ও সংরক্ষণের উপায় ১৩

ড্রিপ বা বিন্দু সেচ পদ্ধতির সুবিধাঃ 

১) যে সকল অঞ্চলে ভীষণভাবে জলের ঘাটতি রয়েছে সেইসকল জায়গায় ভালভাবে প্রযোজ্য।

২) এই পদ্ধতিতে সেচের জলের সঙ্গেই আগাছানাশক এবং সার প্রয়োগ করা সম্ভব। এই পদ্ধতিকে Fertigation (Fertilizer+ Irrigation) & Herbigation ( Herbicide+ irrigation) বলে।

৩) রোগ এবং আগাছার প্রকোপ অনেকটাই কম।

৪) বিভিন্ন ফসলের ক্ষেত্রে এই পদ্ধতিতে জল সাশ্রয় ৫০-৭০% পর্যন্ত।

ড্রিপ বা বিন্দু সেচ পদ্ধতির অসুবিধাঃ

ক) পাইপের নলগুলি বন্ধ হয়ে যায়।

খ) গাছের শিকড়ের গোঁড়া লবনাক্ত হয়ে পড়ে।

গ) প্রারম্ভিক খরচ অনেকটাই বেশি।

ক্ষুদ্র সেচের ব্যবহার কেন করবো?

  •  ৭০% অবধি জল সাশ্রয় করে।
  • ৩০% অবধি সারের সাশ্রয় করে।
  • ৪০-৫০% অবধি আগাছার প্রকোপ কমায়।
  • ২৫-৮০% অবধি ফলন বাড়ায়।
  •  শক্তি এবং খাদ্যেরও সাশ্রয় করে।
  • স্বয়ংক্রিয়ভাবে কাজ করায় শ্রমিক অনেক কম লাগে।
  •  কম খরচে অধিক লাভ।

জল সঞ্চয় ও সংরক্ষণের উপায় ১৬

 

জল বিভাজিকা ব্যবস্থাপনা ও জমি রুপায়নের দ্বারা জল সংরক্ষণ:  

ভারতবর্ষ অথা পশ্চিমবঙ্গের যে সকল অঞ্চলে বৃষ্টিপাত কম হওয়ার দরুন ভূগর্ভস্থ জলের অভাব দেখা যায় সে সকল অঞ্চলে জমি রুপায়নের বিভিন্ন পদ্ধতি দ্বারা জল সংরক্ষণ করা সম্ভব।

জমি রুপায়নের বিভিন্ন ব্যবস্থাপনাঃ

  • বাঁধ দেওয়া/সিমেন্ট প্লাগ/নালা বাঁধ (Check dam): শুষ্ক ও মালভূমি অঞ্চলে বৃষ্টিপাতের ফলে মাটিতে যে রাস্তার মতন চওড়া গর্তের সৃষ্টি হয় এবং বৃষ্টির জল প্রবাহিত হয় সেখানে বাঁধ দিয়ে জল ধরে রাখার ব্যবস্থাপনা করা হয়।
  • অনুস্রবন জলাশয় (Percolation tank): যে সব অঞ্চলের মাটি, মাটির নীচে জল প্রবেশের জন্য ভেদ্য, সেখানে কৃত্রিম জলাশয় খনন করে ভূ-গর্ভস্থ জলের পরিমাণ বাড়ানো হয়। এই জলাশয় পলি সঞ্চয়কারী হিসাবেও কাজে লাগে।
  • পলি সঞ্চয়কারী পুকুর (Silt detention tank): কৃত্রিমভাবে ছোট্ট পুকুর খনন করে অত্যধিক বৃষ্টিপাতের ফলে জমি থেকে পলি ধুয়ে যায় তা এই পুকুরে সঞ্চিত হয়।
  • খামার পুকুর (Farm pond) ও কুয়ো খনন (Dug wells): খামার পুকুর ও কুয়োর জল বর্ষা পরবর্তীতে গাছের জীবনদায়ী সেচের কাজে ব্যবহৃত হয়।
  • প্রশস্ত বেড এবং খাঁজকাঁটা জমি ( Broad bed and furrow): জমির খাঁজগুলিতে বর্ষার জল সংগৃহীত হয় এবং প্রশস্ত বেড দিয়ে অতিরিক্ত জল বেরিয়ে যায়।
  •  উঁচু এবং নীচু বেড জমি তৈরি (Raised and Sunken bed): জমির উঁচু অংশে কম জল লাগে এমন ফসল এবং নিচু অংশে বৃষ্টির জল সংরক্ষিত হয় যেখানে  ধান চাষ করা যায়।

জল সঞ্চয় ও সংরক্ষণের উপায় ৫

বহুমুখী নদী পরিকল্পনা [Multi-purpose River Project]:- নদী বহুল ভারতবর্ষের নদীগুলোর মোট জল প্রবাহের কেবলমাত্র ৬ শতাংশ জল সেচের জন্য এবং ১.৫ শতাংশ জল বিদ্যুৎ উৎপাদনের কাজে ব্যবহৃত হয়, বাকি অংশ অব্যবহৃত থাকে । এছাড়া ভারতের নদীগুলো বিশেষ করে বর্ষাকালে ভয়াবহ বন্যার সৃষ্টি করে । যে পরিকল্পনার সাহায্যে নদীগুলোর উপর বাঁধ দিয়ে একই সঙ্গে বিভিন্ন উদ্দেশ্য সাধন, বিশেষ করে নদীর অববাহিকা অঞ্চলের অধিবাসীদের জীবন যাত্রার মানের সর্বাঙ্গীণ উন্নতির জন্য নদী প্রবাহকে বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করা হয়, তাকে ‘বহুমুখী নদী পরিকল্পনা’ বলা হয়, স্বাধীনতা লাভের পর সরকার এই জল সম্পদকে কাজে লাগানোর জন্য বহুমুখী নদী পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন । এই পরিকল্পনা গুলোর নদী গুলোর ওপর বাঁধ দিয়ে জলাশয় বা কৃত্রিম হ্রদ সৃষ্টি করা হয় ।

  • যেমন :-দামোদর নদী পরিকল্পনা, ভাকরা নাঙ্গাল নদী পরিকল্পনা ।

জল সঞ্চয় ও সংরক্ষণের উপায় ২

দৈনন্দিন জীবনে যে বিষয়গুলি আমরা এড়িয়ে যায়ঃ 

  • কমোডে: ফ্লাশ করলে ২০ লিটার, বালতিতে৫ লিটার সঞ্চয়: ১৫ লিটার
    • স্নান: শাওয়ারে ১৮০ লিটার, বালতিতে ১৮ লিটার। সঞ্চয়: ১৬২ লিটার
    • বাসন ধোয়া: কল খুলে ১১৬ লিটার, বালতিতে ৩৬ লিটার সঞ্চয়: ৮০ লিটার
    • দাড়ি কামানো: কল খুলে ১০ লিটার, মগে নিয়ে ১ লিটার সঞ্চয়: ৯ লিটার
    • গাড়ি ধোয়া: পাইপ দিয়ে ১০০ লিটার, বালতিতে ও ভিজে কাপড়ে ২০ লিটার সঞ্চয়: ৮০ লিটার
    • কাপড় কাচা: কল খুলে ১২০ লিটার, বালতিতে ২০ লিটার সঞ্চয়: ১০০ লিটার
    • জলশোধন: RO মেশিনে হলে ৮ লিটার বিশুদ্ধ জল পেতে ১২ লিটার জল নষ্ট করতে হয়।

জল সঞ্চয় ও সংরক্ষণের উপায় ২

ভূগর্ভস্থ জল সংরক্ষনে আমাদের যা যা করনীয় সেইবিষয়গুলির দিকে নজর দিতে হবে- 

  • সর্বক্ষেত্রে জলের অপব্যবহার বন্ধ করতে হবে ।
  • যতটুকু জলের প্রয়োজন সেই পরিমান জল কৃষিজমিতে ব্যবহার করতে হবে । প্রয়োজনে কৃষির প্রকারভেদের পরিবর্তন       করতে হবে ।
  • গৃহস্থের ব্যবহৃত জলকে পরিশোধন করে পুনর্ব্যবহারের ব্যবস্থা করতে হবে ।
  • জলা ভূমি ও ছোট বড় জলাশয় গুলিকে রক্ষা করতে হবে। প্রয়োজনে নতুন নতুন জলাশয় সৃষ্টি করতে হবে ।
  • বনাঞ্চল সৃষ্টি ও সবুজায়নের মাধ্যমে মাটির জলধারণের ক্ষমতা বাড়িয়ে ভূগর্ভস্থ জলতলের সমতা বজিয়ে রাখতে হবে ।
  • প্রাযুক্তিক উপায়ে জলদূষণ রোধ করতে হবে ।
  • ভারতবর্ষে তুষারপাত ও বৃষ্টির জলের পরিমান মোট প্রায় ৪০০০ মিলিয়ন কিউবিক মিটার যা ভূপৃষ্ঠস্থ ও ভূগর্ভস্থ জল সম্পদের থেকেও বেশি । এই বিশাল পরিমান জল বিভিন্ন পদ্ধতিতে ব্যবহার করতে হবে ।
  • বৃষ্টির জলকে সংগ্রহ করে ভূগর্ভস্থ জলাধারে পাঠিয়ে ভূগর্ভস্থ জলসম্পদের পরিমান বৃদ্ধি করতে হবে ।
  • প্রত্যেক বাড়িতে বৃষ্টির জল কোন জলাধারে সঞ্চিত করে পানীয় জল হিসাবে বা গৃহস্থালির অন্যান্য কাজে ব্যবহার করতে হবে ।
  • সেচের জন্য বড় বা ছোট পুকুর বানিয়ে বৃষ্টির জলকে ধরে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে ।
  • সবথেকে বেশি গুরুত্ত্ব দিতে হবে মানুষের মধ্যে সচেতনা বৃদ্ধির উপর ।
  • সম্প্রতি দুর্গাপুর সেন্ট্রাল মেকানিক্যাল রিসার্চ ইন্সটিটিউট সৌর বিদ্যুৎচালিত ব্যাটারি দিয়ে একটি স্প্রেয়ার মেশিন প্রস্তুত করেছে, তাদের দাবি এই স্প্রেয়ার দিয়ে অতি সূক্ষ্ম কণা নির্গত হবে, যার ফলে অল্প জল দিয়েই বিস্তীর্ণ এলাকায় কীটনাশক প্রয়োগ করা যাবে। এর ফলে একদিকে যেমন কীটনাশকের অপব্যবহার কমবে, তেমনি জলের অপচয়ও রোধ হবে।

\

জল সঞ্চয় ও সংরক্ষণের উপায় ২

জল সঞ্চয় ও সংরক্ষণের উপায় ২

1 Comment

  • প্রতিবেদন টি সুন্দর ও যুক্তি গ্ৰাহ্য । তবে চিত্রগুলি কে আরও আকর্ষণীয় করে তোলা যেত, যা পাঠককে আরও মনোযোগী পাঠকে পরিনত করতে। ধন্যবাদ।

Leave a Comment