টুলকিট

মেদিনীপুরের সাইকেল, ইউরোপের জিও সায়েন্স ইউনিয়ন এবং বায়ু দূষণ।

মেদিনীপুরের সাইকেল, ইউরোপের জিও সায়েন্স ইউনিয়ন এবং বায়ু দূষণ।

বায়ু দূষণ ভারতবর্ষে প্রতি বছর অনেক বেশি মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়। বৈজ্ঞানিক গবেষণা বলছে 2019 সালে শুধুমাত্র বাইরের বায়ু দূষণের কারণে ভারতবর্ষে প্রায় 18 লাখ মানুষ মারা গেছে। প্রতিকারের উপায় বা আমরা কি করব সেই আলোচনায় আমরা আসবো কিন্তু তার আগে আমাদের তো আগে জানতে হবে যে অঞ্চলে আমরা থাকি সেখানে বায়ুদূষণ কতটা? দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ এর বায়ু দূষণ মাপার যন্ত্র গুলো মূলত কলকাতাতেই সীমাবদ্ধ। হলদিয়া বা দুর্গাপুরে আছে বটে কিন্তু যতগুলো থাকা উচিত তার তুলনায় অত্যন্ত কম। জেলাসদরগুলোতে নিয়মিত বায়ুদূষণ মাপা হয় না, অল্পবিস্তর মাপা হলেও তা একটি জায়গাতে যা কখনোই পুরো শহরের ছবি আপনাকে দিতে পারেনা, এবং সব থেকে বড় কথা হল সেই তথ্য কখনোই মানুষের কাছে পৌঁছায় না। 

বহুদিন আগে ডক্টর সৌমেন্দ্র সিংহের সাথে আমি এবং সবুজ পৃথিবী বায়ু দূষণ মাপার একটি যন্ত্র বানাই। সেই যন্ত্রে বাতাসে পিএম 2.5 বা ধূলিকণা যা আমাদের সবথেকে বেশি ক্ষতি করে সেটি মাপা যায়। এর সাথে সাথে সেখানে আর্দ্রতা এবং তাপমাত্রা এবং জিপিএস লোকেশন ও মাপা যায়। 

তারপরের কাজটা খুব সোজা, এই দূষণ মাপক যন্ত্রগুলি আমরা তুলে দিই ওয়েস্ট মিডনাপুর সাইক্লার্স ক্লাবের হাতে। ক্লাব প্রেসিডেন্ট নবনীতা মিশ্র তার সাইকেলে এই যন্ত্র লাগিয়ে পরিক্রমণ করেন সারা মেদিনীপুর। সেখান থেকে গোটা মেদিনীপুরের বায়ু দূষণের একটি ম্যাপ আমরা করতে সক্ষম হই।

মেদিনীপুরের সাইকেল এবং বায়ু দূষণ।

কয়েক মাস আগে আমরা, মানে সবুজ পৃথিবী খুব সামান্য টাকায় বানিয়ে ফেলেছিলাম বায়ু দূষণ পরিমাপক যন্ত্র। কিন্তু যন্ত্র বানালেই তো হল না, সেটা ঠিক ঠাক মান দিচ্ছে কিনা সেটাও দেখতে হবে। আমরা দূষণ মাপক একটি দামি যন্ত্র (আমাদের যন্ত্রের থেকে প্রায় ৫০০ গুন দামি), তার পাসে আমাদের যন্ত্র বসিয়ে দুই যন্ত্রের তথ্য তুলনা করে, আমাদের কম দামি যন্ত্র যে ঠিক ঠাক মাপছে সেটা দেখে নিয়েছিলাম। এর পর আমরা নবনীতাদির সাহায্য চাই যাতে করে তিনি সাইকেলে করে এই যন্ত্র নিয়ে শহর পরিক্রমা করে গোটা শহরে বায়ু দূষণের তথ্য সংগ্রহ করে।

নবনীতা দি, এবং তার সাইকেল ক্লাবের সাহায্যে আমরা গোটা শহরের বিভিন্ন রাস্তার দূষণ মাত্রা মাপি, এবং তা যে বিপদ জনক মাত্রার থেকে অনেকটাই বেশি তা লক্ষ্য করি। ভারতে সম্ভবত প্রথম সাইকেলে করে গোটা শহরের বায়ু দূষণের মাত্রা মাপার প্রয়াস। এই খবর চলে যায় ইউরোপিয়ান জিও সায়েন্স ইউনিয়নে যা জলবায়ু পরিবর্তন এবং বায়ু দূষণ বিষয়ে বিশ্বের সেরা সংস্থা গুলির মধ্যে একটা। তারা আমায় বলে একটা ব্লগ লেখার জন্যে। অবশেষে আগের সপ্তায় এই ব্লগ প্রকাশিত হয়। ওয়েস্ট মিডনাপুর সাইক্লারস ক্লাবকে অসংখ্য ধন্যবাদ। এই ভাবেই বায়ু দূষণ, জলবায়ু পরিবর্তনের মত বিষয় গুলি আস্তে আস্তে আমাদের মজ্জায় মজ্জায় ঢুকে যাক, কারন জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে বন্ধুরা। 

এই প্রসঙ্গে বলে দেওয়া ভালো, এই পরীক্ষা হয়েছিল গত বছর নভেম্বর মাসে। নবনিতা ছাড়াও একাধিক সাইকেল আরোহী বিভিন্ন রাস্তায় ঠিক সন্ধের পর (৭-৮ টার মধ্যে) আমাদের এই যন্ত্র নিয়ে সাইকেল চালায়। যাই হোক, এর ফলাফল দেখতে হলে দুই নম্বর ছবিটি দেখুন। মেদিনীপুরের বড় এবং মাঝারি রাস্তায় আমরা ধূলিকণা ২.৫ বা পিএম২.৫ এর যে মাত্রা পেয়েছি তা স্বাভাবিকের থেকে প্রায় ২-৪ গুন বেশি। ভারতে পিএম২.৫ এর মাত্রা ৬০ মাইক্রোগ্রাম প্রতি ঘন মিটার বাতাসে – এর থেকে কম হওয়া উচিত। সেখানে এই মাত্রা কোথাও ১২০, কোথাও বা ২৪০। 

আমরা দেখেছি, ছোট রাস্তা কিন্তু যেখানে বাস এবং অটো রুট আছে অথবা রাস্তায় সারি সারি খাবারের দোকান এবং প্রচণ্ড ট্রাফিক জ্যাম হয়, সেই অঞ্চলে খুব বেশি এই পিএম২.৫ এর মাত্রা। হাইওয়ে যেখানে কিনা অনেক বড় বড় গাড়ি নিয়মিত যাতায়াত করে, সেখানে মাত্রা কিন্তু শহরের ভেতরের রাস্তার থেকে কম কারন, হাইওয়ের চারিদিকে থাকা ফাঁকা এলাকা এই দূষণ খানিকটা হলেও কমিয়ে দিচ্ছে। শহরের ঘিঞ্জি গলির মধ্যে গাড়ির ধোঁয়া, ধুলো এবং বিভিন্ন আগুনের উৎসের থেকে বের হওয়া পিএম২.৫ আসলে ডিস্পারস হতে পারছে না বা ছড়িয়ে পড়তে পারছে না অত্যাধিক বাড়ির কারণে। 

আমরা আরও দেখেছি, রাস্তার মোড় গুলিতে, রাস্তার তুলনায় বেশি পিএম২.৫ পাওয়া যাচ্ছে। শহরের মধ্যে বাস স্ট্যান্ড এবং বাজার এলাকায় পিএম২.৫ সব থেকে বেশি। সব মিলিয়ে, কোন বড় ইন্ডাস্ট্রি না থাকলেও মেদিনীপুর কিন্তু বায়ু দূষণের দিক থেকে বেশ এগিয়ে। অবশ্যই এখানের দূষণের কতটা স্থানীয় এবং কতটা দুর থেকে (পাঞ্জাব, হরিয়ানা, দিল্লি, উত্তর প্রদেশ, বিহার) উড়ে আসছে সেটা এই ভাবে বলা সম্ভব না। কিন্তু অবশ্যই দুরের দূষণ ও প্রভাবিত করতে পারে মেদিনীপুরের বায়ুকে। এর কারন খুঁজতে অবশ্য আমাদের আরও অন্য পরীক্ষার সাহায্য নিতে হবে, কিন্তু অবশ্যই ধুলো এবং ধোঁয়া আমাদের ফুসফুস বিদীর্ণ করছে প্রতিনিয়ত

Leave a Comment