প্রতিবেদন

IPCC ২০১৩: নীতিনির্ধারকদের জন্য সংক্ষিপ্তসার – পর্ব- ৩। ভবিষ্যতের জলবায়ু

IPCC ২০১৩: নীতিনির্ধারকদের জন্য সংক্ষিপ্তসার - পর্ব- ৩। ভবিষ্যতের জলবায়ু

ভবিষ্যতের জলবায়ু কেমন হবে তা জানার জন্যে কম্পিউটারে জলবায়ু মডেলের সিমুলেসান চালানো হয়। বিশ্ব জলবায়ু গবেষণা কেন্দ্রের কাপলড মডেল ইন্টারকমপ্যারিসন প্রোজেক্ট-৫ (সিমিপ-৫) নামক প্রোগ্রামে বিশ্বের ২০ টি মডেলিং গবেষণারত দল ভবিষ্যতের জলবায়ু নিয়ে একাধিক মডেল সিমুলেসান চালান।   ভবিষ্যতে গ্রিন-হাউস গ্যাসের পরিমান বর্তমানের তুলনায় কিভাবে বাড়বে তা নিয়ে চারটি আদর্শ পথ আই.পি.সি.সি. তৈরি করে। পথ২.৪, পথ৪.৫, পথ৬.০ এবং পথ৮.৫। গ্রিন-হাউস গ্যাসের পরিমান যদি বর্তমানের মতো একই রকম ভাবা বাড়তে থাকে সেক্ষেত্রে জলবায়ু মডেলের সিমুলেসান পথ৮.৫ কে ধরে চালানো হয়; আবার যদি গ্রিন-হাউস গ্যাসের পরিমান সম্পূর্ণভাবে কমিয়ে আনা যায় সেক্ষেত্রে জলবায়ু মডেলের সিমুলেসান পথ২.৪ কে ধরে চালানো হয়। পথ৪.৫ এবং পথ৬.০ এর ক্ষেত্রে গ্রিন-হাউস গ্যাসের পরিমান মাঝারি ধরা হয়। ২.৪, ৪.৫, ৬.০, ৮.৫ এই চারটি সংখ্যা ১৭৫০ সালের তুলনায় ২১০০ সালে রেডিয়েটিভ ফোর্সিং এর মান কত বেশি তা বোঝাতে ব্যাবহার করা হচ্ছে।  

বায়ুমণ্ডলঃ তাপমাত্রা

২০৮১-২১০০ সালের মধ্যে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা ১৯৮৫-২০০৫ এর তুলনায় ০.৩° -১.৭°, ১.১° – ২.৬°, ১.৪° – ৩.১° এবং ২.৬ – ৪.৮° সেলসিয়াস অব্দি বাড়বে। আর্টিক অঞ্চলে এই বৃদ্ধির হার পৃথিবীর গড়ের তুলনায় বেশি হবে এবং স্থলভাগে এই হার জলভাগের থেকে বেশি হবে (প্রায় নিশ্চিত)।

বিশ্বের স্থলভাগের বিভিন্ন জায়গায় আরো বেশি করে হিট ওয়েভ বা চূড়ান্ত গরম তাপমাত্রা দেখা যাবে। হিট ওয়েভের সংখ্যা এবং প্রাবল্য দুইই বৃদ্ধি পাবে (প্রায় নিশ্চিত)।

পথ৪.৫, পথ৬.০ এবং পথ ৮.৫ অনুযায়ী একবিংশ শতকের শেষে গড় তাপমাত্রা ১৮৫০-১৯০০ সালের গড়ের থেকে ১.৫° বেড়ে যাবে (প্রায় নিশ্চিত)।

সূর্যের প্রাবল্যের পরিবর্তন না হলে এবং কোন বড় আগ্নেয়গিরি না জাগলে ২০১৬-২০৩৫ সালের গড় তাপমাত্রা ১৯৮৬-২০০৫ এর তুলনায় ০.৩ – ০.৭° বাড়বে (মাঝারি নিশ্চিত)।

বায়ুমণ্ডলঃ বৃষ্টিপাত

ব্যাতিক্রম কিছু অঞ্চল বাদ দিয়ে বৃষ্টিপাতের পরিমান শুষ্ক অঞ্চলে কমে যাবে এবং আদ্র অঞ্চলে বেড়ে যাবে। অর্থাৎ শুষ্ক অঞ্চল শুষ্কতর হবে এবং আদ্র অঞ্চল আদ্রতর হবে। একই রকম ভাবে বর্ষাকালে বৃষ্টিপাতের পরিমান বৃদ্ধি পাবে এবং অন্যান্য সময়ে বৃষ্টি পাতের পরিমান হ্রাস পাবে।

পথ৮.৫ অনুযায়ী, উচ্চ-অক্ষাংশে বৃষ্টিপাতের পরিমান একবিংশ শতকের শেষের দিকে বৃদ্ধি পাবে এবং নিরক্ষ রেখার কাছাকাছি শুষ্ক অঞ্চলে এবং মধ্য অক্ষাংশে বৃষ্টিপাতের পরিমান কমে যাবে। (মাঝারি নিশ্চিত)।

মধ্য অক্ষাংশ এবং নিরক্ষিয় অঞ্চলে অতিভারি বৃষ্টিপাতের ঘটনার সংখ্যা বেড়ে যাবে। অতিভারি বৃষ্টিপাতের প্রাবল্যও বৃদ্ধি পাবে (প্রায় নিশ্চিত)।

এল নিনো এর প্রাবল্য, বিস্তার এবং ঘনঘটা বৃদ্ধি পাবে। বর্ষাকালের আগমনের দিনের কোন পরিবর্তন না হলেও অচিরেই বর্ষাকাল আরো দীর্ঘস্তায়ী হবে (প্রায় নিশ্চিত)।

বায়ুমণ্ডলঃ বায়ুদূষণ

যদিও বায়ুদূষক গ্যাস এবং কণাগুলি মুলত উৎসের ওপর নির্ভরশীল তাও তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে বাতাসে ওজোনের পরিমান কমে যাবে (প্রায় নিশ্চিত)।

যদিও বৃষ্টিপাত বেড়ে যাওয়ার ফলে ধূলিকণা হ্রাস পায়, কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাতাসে ধূলিকণার পরিমান সরাসরি প্রভাবিত হবে কিনা সেসম্পর্কে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত নন।

সমুদ্রের ভবিষ্যৎ

তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে একবিংশ শতকে সমুদ্রের উষ্ণতা বাড়তে থাকবে, এবং সমুদ্রের তলদেশ ক্রমশ উষ্ণ হওয়ার ফলে সমুদ্রের স্রোতের পরিবর্তন হবে।

নিরক্ষীয় অঞ্চলের কাছাকাছি এবং উত্তর গোলার্ধে সমুদ্রপৃষ্ঠের উষ্ণতা নিশ্চিত ভাবেই সব থেকে বেশি বাড়বে কিন্তু সমুদ্রতলের কাছাকাছি উষ্ণতা অপেক্ষাকৃত বেশি বাড়বে দক্ষিন গোলার্ধের সমুদ্রে।

পথ২.৬ এবং পথ ৮.৫ অনুযায়ী ২১০০ তে সমুদ্রতলের ১০০ মিটার অব্দি উষ্ণতা যথাক্রমে ০.৬° এবং ২.০° বাড়বে এবং আরও গভিরে (১০০০ মিটারে) ০.৩° (পথ২.৬) এবং ০.৬° (পথ৮.৫) বাড়বে।

মেরুপ্রদেশের ভবিষ্যৎ

প্রায় নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে আর্টিক সাগরে বরফের পরিমান ক্রমশ কমতে থাকবে এবং একই সাথে উত্তর গোলার্ধে বসন্তের সময়ে থাকা বরফের পরিমানও হ্রাস পাবে।

একবিংশ শতকের শেষের দিকে আর্টিক সাগরে বরফের পরিমান সেপ্টেম্বর মাসে ৪৩% (পথ২.৬) এবং ৯৪% (পথ৮.৫) আর ফেব্রূয়ারি মাসে ৮% (পথ২.৬) এবং ৩৪% কমবে (পথ৮.৫) (মাঝারি নিশ্চিত)।

অ্যানটারটিকাতে ২১০০ সালে সমুদ্রের বরফের পরিমানও কমবে তবে এই সম্পর্কে বিজ্ঞানী সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিত নন।

উত্তর গোলার্ধে বসন্তে বরফাবৃত অঞ্চলের এলাকা পথ২.৬ অনুযায়ী ৭% এবং পথ৮.৫ অনুযায়ী ২৫% কমবে। এই শতকের শেষের দিকে পারমাফ্রস্ট বা বরফে জমাট বাঁধা মাটির আয়তন ৩৭% (পথ২.৬) থেকে ৮১% (পথ৮.৫) অব্দি কমে যাবে।

সমুদ্র পৃষ্ঠের পরিবর্তন

চার আদর্শ পথ অনুযায়ী সমুদ্রের তল বৃদ্ধির হার একবিংশ শতকের শেষে, ১৯৭১-২০১০ এই সময়ের তুলনায় অনেকাংশে বৃদ্ধি পাবে তাপমাত্রা বাড়ার কারনে এবং বরফ গলার কারনে।

২০৮১-২১০০ সালে, ১৯৮৬-২০০৫ এর তুলনায় ০.২৬-০.৫৫ (০ (পথ২.৬) মিটার এবং ০.৪৫-০.৮২ (পথ৮.৫) মিটার অব্দি বাড়বে (মাঝারি নিশ্চিত)।

যদিও সমুদ্রতলের এই বৃদ্ধি সব জায়গায় সমান হবে না, তাও ৭০% সমুদ্রের তীরবর্তী অঞ্চলের মানুষ, স্বল্প বৃদ্ধিতেই প্রভাবিত হবে।

কার্বন এবং অন্যান্য বায়োজিওকেমিক্যাল চক্রের পরিবর্তন

বাতাসে কার্বন ডাই অক্সাইড বাড়ার সাথে সাথে সমুদ্রে দ্রবীভূত কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমানও বাড়তে থাকবে যা একুশ শতকের শেষের দিকে সমুদ্রের অম্লতাকে বহুলাংশে বাড়িয়ে দেবে। সমুদ্রের পি.এইচ ০.৬ – ০.৭ (পথ২.৬) এবং ০.৩০ – ০.৩২ (পথ৮.৫) অব্দি কমে যাবে।

কার্বন চক্র এবং জলবায়ু পরিবর্তনের মধ্যে চক্রাকার সম্পর্কটি ধনাত্মক অর্থাৎ জলবায়ু পরিবর্তন ভবিষ্যতে সমুদ্র এবং স্থলভাগের কার্বন সঞ্ছয়ের ক্ষমতাকে কমিয়ে দেবে যার ফলস্বরূপ বাতাসে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমান বৃদ্ধি পাবে।

জলবায়ু পরিবর্তনের স্থিতিশীলতা, প্রত্যাবর্তন যোগ্যতা এবং প্রতিশ্রুতি 

একবিংশ শতকে ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রধানতম কারন মানুষের কর্মকাণ্ডের দরুন বাতাসে বেড়ে যাওয়া কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমান।

ক্রমবর্ধমান উষ্ণায়নকে ১৮৬১-১৮৮০ এর তুলনায় ২° সেলসিয়াস কম রাখার জন্য মানুষের কর্মকাণ্ডের জন্য নির্গত কার্বনের পরিমান সেই সময়ের তুলনায় সর্বমোট ১০০০ গিগাটনের মধ্যে রাখতে হবে (৬৬% সম্ভাবনা)। ১৮৬০ থেকে বর্তমান অব্দি মানুষ সর্বমোট ৫০০ গিগাটনের কাছাকাছি।

কার্বন ডাই অক্সাইডের ফলে হওয়া জলবায়ু পরিবর্তনের অনেকাংশই কয়েক শতক পরেও পূর্বের (ইন্ডাসট্রিয়াল রেভলিউসানের আগে) অবস্থায় ফিরে যাবে না। কার্বন ডাই অক্সাইডের নির্গমনের পরিমান সম্পূর্ণ কমে গেলেও কয়েক শতক অব্দি গড় তাপমাত্রার পরিবর্তন হবে না। একই ভাবে কমবে না সমুদ্রের তাপমাত্রাও।

সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতাও ২১০০ সালের পর ক্রমশ বৃদ্ধি পেতেই থাকবে। কিছু কিছু জলবায়ু মডেল অনুযায়ী ২৩০০ সালে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্ছতা ১-৩ মিটার অব্দি বৃদ্ধি পাবে (পথ৮.৫)। গ্রিনল্যান্ডের বরফের চাঙড়গুলি পরবর্তী ১০০০ বছরের মধ্যে সম্পূর্ণ গলে গিয়ে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্ছতা ৭ মিটার অব্দি বাড়িয়ে দিতে পারে।

জলবায়ু পরিবর্তনকে প্রতিরোধের জন্যে জিও-ইঞ্জিনিয়ারিং এর দুটি সমাধানের ভবিষ্যৎ উপযোগিতা গণনা করা হয়েছে। তারমধ্যে একটি, কার্বন ডাই অক্সাইডের বাতাস থেকে শোষণ (রিমুভাল) করে নেওয়ার বেশ কিছু সমস্যা ইতিমধ্যেই প্রকট। ওপর উপায়টি হল সূর্য শক্তির ব্যবস্থাপনা যা যদি বাস্তবে করা সম্ভব হয় সেক্ষেত্রে তাপমাত্রা কমাতে সক্ষম হলেও সামুদ্রিক অম্লতাবৃদ্ধি আটকাতে সক্ষম নয়। এই দুই পদ্ধতির অসংখ্য সুদূরপ্রসারী প্রভাব আছে যা বর্তমানে গবেষণার বিষয়।

তথ্যসুত্রঃ ipcc.ch

ছবিঃ www.annauniv.edu

 

আরো পড়ুনঃ IPCC ২০১৩: নীতিনির্ধারকদের জন্য সংক্ষিপ্তসার – পর্ব-১ | জলবায়ু পরিবর্তনের অতীত এবং বর্তমান

IPCC ২০১৩: নীতিনির্ধারকদের জন্য সংক্ষিপ্তসার – পর্ব-২ | জলবায়ু পরিবর্তনের কারন

Leave a Comment