টেকনোলজির বিকাশের কারনে আমরা উনবিংশ শতাব্দী থেকে সারা বিশ্বের বিভিন্ন জায়গার আবহাওয়ার সূচকগুলি (তাপমাত্রা, আদ্রতা, বায়ুর চাপ, বৃষ্টিপাত ইত্যাদি) কৃত্রিম উপগ্রহ এবং আবহাওয়া অফিসের নিজস্ব ষ্টেশন থেকে পেতে শুরু করি। হাজার হাজার বছর আগের জলবায়ু কেমন ছিল তা জানতে বিজ্ঞানিরা বিভিন্ন মডেল এবং প্রক্সি ডেটার ব্যাবহার করেন। সামগ্রিকভাবে জলবায়ুর উস্নায়ন নিশ্চিতভাবেই হয়েছে এবং ১৯৫০ এর পরবর্তী সময়ে জলবায়ুর এই রূপ আগে কখনো দেখা যায় নি। বাতাসে গ্রিনহাউস গাসের বৃদ্ধির সাথে সাথে বেড়েছে সমুদ্রের জলস্তর, বেড়েছে ভূপৃষ্ঠ এবং সমুদ্রের তাপমাত্রা এবং কমেছে মেরু প্রদেশের বরফ।
বায়ুমণ্ডলের পরিবর্তন
মিলিতভাবে ভূপৃষ্ঠ এবং সমুদ্রপৃষ্ঠর তাপমাত্রা ১৮৮০ থেকে ২০১২ অব্দি ০.৮৫° (০.৬৫° – ১.০৬°) সেলসিয়াস বেড়েছে। ১৮৫০ থেকে ১৯০০ সালের গড় তাপমাত্রা, ২০০০ থেকে ২০১২ সালের গড় তাপমাত্রার থেকে ০.৭৮° (০.৭২° – ০.৮৫°) সেলসিয়াস বেশি।
১৮৮০ থেকে প্রত্যেক বছরে ঠাণ্ডা দিনের সংখ্যা গোটা পৃথিবী জুড়ে কমেছে; বেড়েছে গরম দিনের সংখ্যা। এশিয়া, অস্ট্রেলিয়া এবং ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চলে হিট ওয়েভ বা উষ্ণপ্রবাহ বৃদ্ধি পেয়েছে।
বৃষ্টিপাতের প্রাবল্য উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে। অল্প সময়ে প্রবল বৃষ্টিপাত হওয়া ঘটনা বেড়েছে। অর্থাৎ চরম বৃষ্টিপাতের সংখ্যা এবং চরম বৃষ্টির পরিমান দুইই বৃদ্ধি পেয়েছে।
জলমণ্ডলের পরিবর্তন
নিশ্চিতভাবে সমুদ্রপৃষ্টের তাপমাত্রা (৭৫ মিটার অব্দি) শেষ ৪০ বছরে (১৯৭১ থেকে ২০১০) ০.১১° (০.০৯° – ০.১৩) বৃদ্ধি পেয়েছে। সমুদ্রের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায়, উপকুলবর্তি সামুদ্রিক তাপমাত্রার বৃদ্ধির হার সবথেকে বেশি।
১৯৭১ থেকে ২০১২ সাল অব্দি চার দশকে, উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে হওয়া শক্তিবৃদ্ধির ৯০ ভাগই সমুদ্রে সঞ্চিত হয়েছে এবং এর মধ্যে ৭০ ভাগ সমুদ্রের ওপরের অংশে সঞ্চিত হয়েছে।
প্রায় নিশ্চিত ভাবে বলা যায় যে সমুদ্রের বেশি নোনা অংশে অতিরিক্ত বাষ্পীভবনের ফলে অধিকতর নোনা হয়ে যাচ্ছে এবং অপেক্ষাকৃত কম নোনা অংশে অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের ফলে ক্রমশ লবনের পরিমান ক্রমশ কমছে। অর্থাৎ সমুদ্রের ওপর বিভিন্ন অংশে ১৯৫০ এর পর থেকে বৃষ্টিপাত এবং বাষ্পীভবনের তারতম্ম্য দেখা দিচ্ছে।
মেরুপ্রদেশের পরিবর্তন
১৯৭১ থেকে ২০০৯ অব্দি পৃথিবীর বিভিন্ন গ্লেসিয়ার থেকে গড়ে প্রতিবছর ২২৬ (৯১ – ৩৬১) গিগাটন পরিমান বরফ গলেছে। শেষ ১৭ বছরে (১৯৯৩ – ২০০৯) বরফ গলার এই হার প্রতি বছর ২৭৫ (১৪০ -৪১০) গিগাটন।
১৯৯২ থেকে ২০১০ সালে অ্যান্টারটিকাতে বরফ গলার হার প্রতিবছর ছিল ৩০ (-৩৭ – ৯৭) গিগাটন। পরবর্তী দশ বছরে সেই হার বেড়ে দাড়ায় ১৪৭ (৭২ – ২২১) গিগাটন প্রতি বছর। একই ভাবে আইসল্যান্ডে বরফ গলার হার ৩৪ (-৬ – ৭৪) থেকে ২১৫ (১৫৭ – ২৭৪) গিগাটন বাড়ে এই সময়ে।
১৯৭৯ থেকে ২০১২ এর মধ্যে আর্টিকের সমুদ্রের বরফ প্রতি দশকে ৩.৫ – ৪.১% হারে কমছে। একই রকম ভাবে বরফে ঢাকা উত্তরমেরু প্রতি দশকে ১.৬% (মার্চ/এপ্রিল) – ১১.৭% (জুন) অব্দি বরফের আবরন সরে যাচ্ছে।
তারমাত্রা বাড়ছে পারমাফ্রস্ট বা বরফে জমাট বাঁধা মাটির। উত্তর আলাস্কাতে ৩° সেলসিয়াস এবং রাশিয়াতে পারমাফ্রস্ট মাটির তাপমাত্রা ২° সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেয়েছে।
সমুদ্রপৃষ্ঠের পরিবর্তন
উনবিংশ শতকের মাঝামাঝি থেকে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্ছতা বৃদ্ধি পূর্ববর্তী শতকগুলির তুলনায় অনেকাংশে বেশি। ১৯০১ থেকে ২০১০ অব্দি সমুদ্র প্রতিবছর ১.৭ (১.৫ – ১.৯) মিলিমিটার করে বাড়ছে। ১৯৯৩ থেকে ২০১০ অব্দি এই হার দ্বিগুণের কাছাকাছি (৩.২ মিলিমিটার প্রতি বছর)।
১৯৭০ এর পরবর্তী সময়ে গ্লেসিয়ারের গলে যাওয়া এবং তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্যে সমুদ্রের জলের আয়তন বৃদ্ধি; সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্ছতা বৃদ্ধির জন্য ৭৫ ভাগ দায়ী।
কার্বন এবং অন্যান্য বায়োজিওকেমিক্যাল চক্রের পরিবর্তন
১৭৫০ এর ইন্ডাস্ট্রিয়াল রেভলিউসানের পর থেকে কার্বন ডাই অক্সাইড, মিথেন এবং নাইট্রাস অক্সাইডের মাত্রা ক্রমশ বৃদ্ধি পায় এবং সেই সময়ের সাপেক্ষে, ২০১১ সালে এই গ্যাস ত্রয়ের উপস্থিতি বাতাসে যথাক্রমে ৪০%, ১৫০% এবং ২০% বেশি।
বিগত আট লক্ষ বছরের মধ্যে বর্তমানে তিন গ্যাসের পরিমান সর্বাধিক এবং শেষ বাইশ হাজার বছরের মধ্যে এই তিন গ্রিন হাউস গ্যাসের বৃদ্ধির হারও সর্বাধিক সীমায় পৌঁছেছে।
১৭৫০ এর পর থেকে জীবাশ্ম জ্বালানি (কয়লা, পেট্রোলিয়াম ইত্যাদি) এবং সিমেন্ট উৎপাদন ৩৭৫ (৩৪৫ – ৪০৫) গিগাটন অতিরিক্ত কার্বন ডাই অক্সাইড বাতাসে মিশিয়েছে। অন্যদিকে গাছ কাটা এবং নগরায়নের কারনে ১৮০ (১০০ – ২৬০) গিগাটন কার্বন ডাই অক্সাইড বাতাসে মিশেছে।
২৪০ (২৩০ – ২৫০) গিগাটন কার্বন ডাই অক্সাইড গ্যাস হিসেবে বাতাসে রয়ে যায়; ১৫৫ (১২৫ – ১৮৫) গিগাটন সমুদ্রে মিশে থাকে এবং বাকি ১৬০ (৭০ – ২৫০) গিগাটন স্তলজ বাস্তুতন্ত্রে (জঙ্গল, জলাভুমি ইত্যাদি) আবদ্ধ থাকে।
অতিরিক্ত কার্বন ডাই অক্সাইড সমুদ্রের জলে দ্রবীভূত হওয়ার কারনে সমুদ্রের জলে অম্লত্বের পরিমান বেড়ে যাচ্ছে। ইন্ডাস্ট্রিয়াল রেভলিউসানের পর থেকে সমুদ্রের জলের অম্লতা (pH) ০.১ কমে গেছে।
তথ্যসুত্রঃ ipcc.ch
আরো পড়ুনঃ IPCC ২০১৩: নীতিনির্ধারকদের জন্য সংক্ষিপ্তসার – পর্ব-২ | জলবায়ু পরিবর্তনের কারন
IPCC ২০১৩: নীতিনির্ধারকদের জন্য সংক্ষিপ্তসার – পর্ব- ৩। ভবিষ্যতের জলবায়ু