বন্ধুদের লেখা

জলবায়ু সঙ্কট ও আমাদের কাজ

জলবায়ু সঙ্কট ও আমাদের কাজ

লেখক পরিচিতি : অমিতাভ আইচ

অমিতাভ আইচডঃ অমিতাভ আইচ দীর্ঘদিন যাবৎ পরিবেশ গবেষনা, পরিবেশ আন্দোলন এবং সুস্থায়ী কৃষি ও মৎস্য চাষের সাথে জড়িত। ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে সুস্থায়ী উন্নয়নের একাধিক সফল মডেল অমিতাভ বাবুর নিজের হাতে করা

 

 —————————————————————————————————————

 

আমরা যারা পরিবেশ বা জলবায়ু গবেষণার সাথে  যুক্ত তাদের প্রায়ই শুনতে হয় যে বলুন তো এমন কি কি করা যায় যাতে জলবায়ু পরিবর্তনের এই করাল গ্রাস থেকে আমরা বাঁচতে পারি। কেউ বলেন গাছ লাগালে কি হবে, বা পুকুর বাঁচালে বা ধরুন যদি প্লাস্টিকের ব্যবহার কমালে কি ভাল? আচ্ছা যদি এসি কম চালাই, মাটির তলায় জল জমাই, ছাদ বাগান করি বা গাড়ির বদলে সাইকেল চালাই তাহলে কি এসব থেকে মুক্তি পাবো?  এসব প্রশ্ন শুনে আমরা একটু চুপ করে যাই। কারন  এটা বলা বেশ কঠীন যে কোন কিছু না করতে পারার চেয়ে এসব গুলো করা বেশ ভাল হলেও এসব কিছুর প্রভাব বিশ্ব উষ্ণায়নের মতো বিরাট ও জটীল প্রক্রিয়ার উপর খুবই ক্ষীণ।

প্রকৃতপক্ষে শিল্প বিপ্লবের সময় থেকে উন্নত বিশ্বে যে বিপুল পরিমান জীবাশ্ম  জ্বালানি পোড়ানো হয়েছে ও তার পরবর্তী কালে উন্নয়ন, প্রগতি ও দারিদ্র্য দূরীকরণের নাম করে, বিশেষ করে দ্বিতীয়  বিশ্বযুদ্ধের পর  সারা পৃথিবীতে ও বিশেষ করে পুঁজিবাদী পশ্চিমা দেশগুলিতে, বামপন্থী রুশ ও চিনে, দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়াতে ও গোটা লাতিন আমেরিকায়  যে প্রাকৃতিক পরিবেশ বিনষ্ট করে গ্রীনহাউজ গ্যাসের উৎপাদন বাড়ানো হয়েছে তার ফলে  পরিবেশ ও জলবায়ু যেভাবে ব্যবহার করতে শুরু করেছে আমাদের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠতম জলবায়ু পরিবর্তন নিরীক্ষণ ও পর্যবেক্ষণ রত মডেল ও সুপার কম্পুটার গুলি তার সম্পর্কে একটি কথা নিশ্চিত ভাবে বলছে আর সেটা হলো এই পরিবর্তন এখন ইরিভার্সিবল বা এক কথায় এই পরিবর্তনের চাকা আর উল্টোদিকে ঘোরানো সম্ভব নয়।

তাহলে আমরা করবো টা কি? আমাদের কি সত্যি কোন করনীয় নেই। আছে নিশ্চিত ভাবেই আছে তবে তার আগে বোঝা দরকার  কোন সখ সৌখিনতা বা নিজেদের ভাল লাগা বা সাধারণ জন সেবার বোধ থেকে আমরা যে গাছ পালা ফুল পাখি নদী, গাছ অক্সিজেন দেয় তাই গাছ লাগাও বা গাছ কেটো না এমন চিন্তা করে নানান কাজ করি এই কাজ তারচেয়ে অনেক বেশি গভীর, অনেক বেশি মাটির কাছাকাছি  ও অনেক বেশি বহ বিষয় সমৃদ্ধ ও জটীল কাজ। যেখানে বহু আপাত খারাপ লাগা বিষয় কেও ভাল লাগার সাথে মিশিয়ে বৃহৎ স্বার্থে র সন্ধানে আপন করার দরকার পড়তে পারে। দরকার পড়তে পারে অনেক বেশি ধৈর্যের ও গভীরে যাওয়ার। হ্যাঁ এই কাজ করতে গেলে যিনি প্লাস্টিক দূষন দূর করতে চান তাকে ভারতের জল সম্পদ, তুলোচাষ আর পাওয়ার লুম ইন্ডাস্ট্রি সম্পর্কে জানতে হবে, কারন সূতো আর কাপড়েই লুকিয়ে আছে সবচেয়ে বেশি প্লাস্টিক আর তুলো চাষ সবচেয়ে বেশি জলখেকো ও তাই কৃষিতে সবচেয়ে বেশি কার্বন নিঃসরণের জন্য দায়ী এটা বুঝতে হবে। যিনি বলছেন কয়লা দূষন কমিয়ে সৌর বা বায়ুবিদ্যুৎ কি জলবিদ্যুৎ চাই, তাকে তখন দেখে নিতে হবে কোন সৌর বিদ্যুৎ ও বায়ু বিদ্যুৎ যা গুজরাট, রাজস্থানের প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্র ধ্বংস করে, পরিযায়ী পাখিদের মৃত্যুর কারন হয়ে চলেছে নাকি সেই জলবিদ্যুৎ যা যাবতীয় নদীকে প্রায় মেরে ফেলেছে।

নীতির লড়াই

জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়ার মুলতো দুটো পথ, একটা হলো মিটিগেশন বা কমানো, আর আরেকটা হলো এডাপটেশন বা মানিয়ে নেওয়া।। পৃথিবীতে মিটিগেশন নিয়ে আপাতত বিরাট লড়াই চলছে। ভারতের মতো দেশ গুলো কয়লার ব্যবহার কমাতে রাজি নয়। তাদের যুক্তি তোমরা এতো বছর ধরে পুড়িয়ে এসব করেছো, নিজেরা ধন সম্পদ বানিয়েছো, আমরা সবে পোড়াচ্ছি, এখন যদি বন্ধ করতে হয়, আমাদের চলবে কি করে, এতো এতো লোক যারা এসব সেক্টরে কাজ করে যাবে কোথায়? বস্তুত ভারতের কোল ইকোনমি প্রায় ৮০% জুড়ে রাজ করছে। তাই কাজটা মারাত্মক কঠীন। যেমন যদি আজ এমন হয় আমরা মিডিলইস্টের খনিজ তেলের উপর প্রচুর উৎপাদন শুল্ক চাপিয়ে দিলাম যাতে খনিজ তেল কম বিক্রি হয়, তাতে কম তেল বিক্রি হয়ে তেল ব্যবসা অলাভজনক হয়। বিষয়টা ভাবার তুলনায় করা অনেক বেশি কঠীন। আর যদি কোনদিন মিডিলইস্টের তেলের ব্যবসায়ে টান পড়ে তবে ভারতের উপরে তার প্রভাব কি? ভারত খনিজ তেল আমদানি করে, বেশ তেলের বদলে অন্য কিছু দিয়ে গাড়ি চললো, সেটাও মারাত্মক কঠীন যদিও অতো গাড়ি বিকল্প শক্তিতে চালানো, আর সেটাই বা কি? আমরা নিশ্চিত নই। তবে এর প্রভাব ভারতের উপর সবচেয়ে বেশি পড়বে কর্মক্ষেত্রে।  যে বিপুল পরিমান ভারতীয় এই সব দেশে কাজ করেন ও যে বৈদেশিক মুদ্রা দেশে পাঠান তা বন্ধ হয়ে যাবে, এক কথায় এক অর্থনৈতিক বিপর্যয় হবে। এই অবস্থা থেকে বাঁচতে কমপেনসেটরি কার্বন ফান্ডের  কথা বলা হয়েছে। আর এই টাকা যতক্ষণ না উন্নত বিশ্ব থেকে অনুন্নত বা উন্নয়নশীল দেশে আসবে যাতে তারা বিকল্প করতে তৈরী পারবে। সে টাকার টিকি নেই। তাই এতো সহজে এর সমাধান হবে না।

উপায় করনীয়

লেখা শুরু করেছিলাম উপায় কি তা দিয়ে, তাই লেখা দীর্ঘায়িত না করে কতো গুলি উপায় ও লক্ষ্যের কথা বলছি যা পরিবেশ কর্মীরা প্রচার ও অভ্যাস  স্থানীয় ভাবে করতে পারেন। এই খানে দাবী সনদ তৈরীর তুলনায় নিজেদের খামতি পূরনের প্রয়োজনীয়তাকে অনেক বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

মিটিগেশনঃ

১) সৌর বিদ্যুৎ, জলবিদ্যুৎ, বায়ুবিদ্যুৎ কেন্দ্র যেনো কোন ভাবেই প্রাকৃতিক পরিবেশ ও বন্য প্রাণীর কষ্টের ও বিনাশের কারন না হয়্ এটা সবার আগে মাথায় রাখতে হবে। ছোট হলো সুন্দর ও ভাল, এই কথা মাথায় রেখে বাড়ির ছাদের নেট মিটারিং করা সৌর বিদ্যুৎ এর দাবী আরও জোরদার করতে হবে। ইরিগেশন ক্যানেল আরেকটি ভাল জায়গা সৌর বিদ্যুৎ এর। সবচেয়ে বড় কথা একজায়গায় তৈরী করে পাওয়ার গ্রীড করে আরেক জায়গায় পাঠানোর পুরো প্রক্রিয়াটাই পরিবেশের পক্ষে  বিনাশকারী ও কার্বন ইন্টেনসিভ। এর বিরুদ্ধে বলতে হবে ও এলাকার বিদ্যুৎ এলাকার জন্য দাবী তুলতে হবে। পাখির যাতায়াতে বাধা দান করে না এমন বায়ু বিদ্যুৎ জেনারেটার তৈরী হয়ে গেছে। এই কথা সরকারকে মনে কে করাবে?

২) উন্নয়ন মূলক কাজ যতো নেচারবেসড হবে তত কার্বন নিঃসরণ কম হবে ও প্রকৃতি বাঁচবে, গাছ রেখে রাস্তা, হাতির বা বন্য প্রানীর করিডরে আন্ডার বা অভার পাস, নদীর বাঁধ জলোচ্ছ্বাস ও ভাঙ্গন রোধী ঘাস, গাছ পালা দিয়ে বানানোর পদ্ধতির নানান মডেল এখন আছে, সেগুলি জেনে নিয়ে জননেতাদের নাকের ডগায় ফেলতে হবে।

৩) ইকোসিস্টেম সার্ভিস ভ্যালু এমন একটা বিষয় যেটা এমন সব ইনডায়রেক্ট ভ্যালু বা ননট্যানজিবল ভ্যালুকে সামনে আনে যেগুলোর  কোন মুল্য আছে আমরা ভাবতে পারি না। অথচ সামনে এলে বোঝা যেতো যে একটা জলা বা পুকুর, একটা বন পরিবৃত আদিবাসী গ্রাম, একটা ম্যানগ্রোভ বন বা নেহাতি একটা বা একাধিক গাছ, একটা ছোট্ট নদী বা নালা আমাদের কি অর্থনৈতিক সুবিধা দিচ্ছে। এলাকার প্রাকৃতিক সম্পদের অর্থনৈতিক হিসাব করে তা নীতি প্রনয়নকারী, ও এলাকার সকল মানুষের কাছে প্রকাশ ও প্রসার করলে সেটা রক্ষার কাজ অনেক অগ্রগতি পাবে। তাহলে পরিবেশ কর্মীদের নিজেদেরও ক্যাপাসিটি বিল্ডিং ও হোমটাস্ক  দরকার? এটা তাহলে নিজেদের জিজ্ঞেস করতে হবে সেটা করতে তারা রাজি কিনা। নাকি দাবী সনদ, মিছিল, মিটিং আর অনুষ্ঠান এই টুকু করলেই সব হয়ে যাবে।

এডাপটেশনঃ

এক কথায় মানিয়ে নেওয়ার প্রচেষ্টা ও প্রস্তুতি। কয়েকটা উদাহরণ নীচেঃ

১) বেশি বৃষ্টি, বন্যা, খরা, তাপমাত্রা বেশি বেড়ে গেলে বা জলবায়ু পরিবর্তনের এক্সট্রিম ইভেন্ট বেড়ে গেলে আমরা প্রস্তুত তো? তেমন বীজ, চাষ পদ্ধতি, বাজার, ইন্সূরেন্স, কনটিজেন্সি প্ল্যান, আই টি বেসড এলার্ট সিস্টেম, ট্রেনিং আছে? এলাকার কৃষি অফিসারকে এই কথা জিজ্ঞেস করা বড় কাজ। না থাকলে বিকল্প টা বলা, বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে জেনে। প্রয়োজনে নিজেরা করে দেখানো। দেশি ধানের চাষ কি করে দেখানো এতই কঠীন?

২) এলাকায় এক সাথে চার পাঁচ দিন বৃষ্টি হলে জল নিকাশি কি পর্যায়ে। পুকুর গুলো, নিকাশি নালি কি অবস্থায়, নিকাশি নালি পর্যন্ত জল যাবে তো? নাকি উন্নয়ন এমনই স্বাভাবিক নিকাশির উল্টোদিকে বা উল্টো ঢালে যে জমা জল ক্রমাগত তেল ও কার্বন পুড়িয়ে বার  করতে হবে? এলাকার পৌর অফিসকে সারাবছর নজরে কে রাখবে?

৩) শহরের বা এলাকার রাস্তার ধারের গাছ গুলি কি ঝড়ের দাপট নিতে সক্ষম, নইলে সঠীক ভাবে প্রুনিং করা দরকার ঝড়ের মরশুমের আগে যাতে হাওয়া না ধরে। সাথে গাছ লাগানোর সময় এটা মাথায় রাখা যে এমন গাছ লাগানো, যাতে ঝড়ে সহজে না ভাঙ্গে। এবিষয়ে বিশেষজ্ঞ দের সাথে কথা বলে সিধান্ত নেওয়া। মাথায় রাখতে হবে শহরের রাস্তায় খেটে খাওয়া মানুষ, স্লাম এলাকার মানুষ, পথ শিশুদের উপর কি প্রভাব জলবায়ু পরিবর্তনের?? এই মারাত্মক হিউমিড হিটের? আর শহর তা কি ভাবে সামলাবে?

৪) আরবান হিটসিঙ্ক সামলানোর জন্য ছাদ বাগান জনপ্রিয় করা দরকার, তারচেয়েও বেশি দরকার এর বিরুদ্ধে (আরবান হিটসিঙ্ক) প্রচার। একই প্রচার চাই রাতের আলো ও গ্রামাঞ্চলে বায়োগ্যাস ও ফসলের বর্জ্য থেকে কোহল সন্ধান পদ্ধতিতে সার তৈরীর প্রচেষ্টার। কোহল সন্ধান পদ্ধতিতে প্রস্তুত সার পৃথিবীর প্রাচীনতম ও আধুনিকতম পদ্ধতি যার জন্ম ভারতে। এই প্রক্রিয়ায় কার্বন নিঃসরণ সবচেয়ে কম হয়, ফসল, মাটি, স্বাস্থ্য ও পরিবেশ সবচেয়ে ভাল থাকে ও কৃষকের আয় বাড়ে।

৫) পলিনেটার বা মৌমাছি, প্রজাপতি ও অন্যান্য পতঙ্গ ও ড্রাগন ফ্লাই ও ঝোপ ঝাড়ে ঢাকা এলাকা কতটা রয়েছে তার পরিমাম একটা বড় কাজ। বড় কাজ এদের সবকিছুর সাথে অর্থনীতি জুড়ে দেওয়া। আর সেটাই হবে ব্রহ্মাস্ত্র। পরিবেশ এক্টিভিস্ট আর পরিবেশ গবেষকের এখানেই যোগসাজশ। 

জলবায়ু পরিবর্তন একটা মড়ন বাঁচন লড়াই। এখন কেউ আর পরিবেশ কর্মী বা নদী বা গাছ কর্মী বা পাখি বা বাঘ দেখিয়ে নেই, হয় না। সবাই জলবায়ু কর্মী। আর সব সঙ্কটই জলবায়ু সঙ্কট। হ্যাঁ ইউক্রেনের যুদ্ধ থেকে বাজারে জিনিশের দাম। তাই রাজনীতি বুঝি না বা কি জটিল মনে হলে চলবে না। সবটা এখন মিলে গেছে, চিরকালই মিলেই ছিলো। এই জলবায়ু লড়াইতে আপনাকে স্বাগতম।

অমিতাভ আইচ

(মুল লেখাটি নেচার ফার্স্ট সংস্থার ২০২২ পরিবেশ দিবস সংখ্যার জন্য লিখিত ও পরিমার্জিত)

Leave a Comment