বন্ধুদের লেখা

সবুজ পৃথিবী বাঁচাও প্রচেষ্টায় সকলের সহযোগ চাই

সবুজ পৃথিবী বাঁচাও প্রচেষ্টায় সকলের সহযোগ চাই

 

লেখক পরিচিতি : কুমারেশ মজুমদার

কুমারেশ মজুমদারকুমারেশ মজুমদার একজন প্রবীণ কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার এবং চিন্তাশীল সমাজও প্রকৃতি বিষয়ক লেখক। গত চার দশকেরও বেশি সময় উনি ভারত, কানাডা, ইউরোপ, আমেরিকা, আফ্রিকা এবং মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে থেকেছেন ও সেখানে কাজ করেছেন। তিনি পেট্রোলিয়াম, শক্তি উৎপাদন,জল সংগ্রহন ও শোধন, প্রাকৃতিক সম্পদ ও পরিবেশ রক্ষা এবং দূষণ নিয়ন্ত্রণ সম্বন্ধীয় বিষয়ের উপর কাজ করেছেন। তিনি প্রকৃতি ও বন্যপ্রাণীর বিষয়ে বিশেষ উৎসাহী।

 —————————————————————————————————————


লেখক কুমারেশ মজুমদারের সদ্য প্রকাশিত ‘মর্ণিং ওয়াক’ বইটা থেকে নেওয়া (অনুবাদ করা)

‘মর্ণিং ওয়াক’ উপন্যাসের পটভূমি (ব্যাকগ্রাউন্ড)

 

১৯৮৫ সালে, এয়ার ইন্ডিয়ার জাম্বোজেট বিমান ‘কণিষ্ক’ কানাডা থেকে নিউদিল্লি যাওয়ার সময় এর ভিতরে, সম্ভবতঃ সন্ত্রাসবাদীদের চক্রান্তে, এক ভয়াবহ বোমা বিস্ফোরণ হয়। বিমানটা আয়ারল্যান্ডের কাছে আটলান্টিক মহাসাগরে ভেঙ্গে পড়ে এবংবিমানের ৩২৯ যাত্রী ও বিমানকর্মী সকলেই মারা যায়। ঘটনার কোন প্রত্যক্ষদর্শীর-বিবরণ পাওয়া যায়নি। সেই করুণ কাহিনি ও মৃতদের পরিবার-পরিজনদের দুই প্রজন্মেরও বেশি সময় ধরে যে হাহাকার ও অকথ্য দুঃখ-দুর্দশা হয়েছিল তার থেকেই খানিকটা তথ্য ও খানিকটা কল্পনা নির্ভর করে ‘মর্ণিং ওয়াক’-এরগল্প ডানা মেলেছে। পৃথিবীর বিভিন্ন সময়রেখাতে অবস্থিত, ভারতবর্ষ সহ বেশ কয়েকটি দেশ ও সেখানের মানুষজন, জীবজন্তু, শহর, গ্রাম, বনভূমি, প্রকৃতির মধ্যে এই গল্পটি বিস্তৃত।

‘মর্নিং ওয়াক’ (প্রাতঃভ্রমণ) উপন্যাসের কাহিনি ও চরিত্র সবই আমাদের পরিচিত। পৃথিবী্র সব দেশে ও সমাজে মানুষের সুখ-দু;খ, ব্যথা-বেদনা, কান্না-হাসি ও পারিপার্শিকের সাথে তাদের সম্পর্ক অনেকটা একই ছাঁদের। তাই উপন্যাসে তাদের প্রতিফলনটাও সকলের চেনা।

কিন্তু ‘মর্নিং ওয়াক’ আর পাঁচটা ছকবাঁধা উপন্যাসের থেকে একটু ব্যতিক্রমী। এর মূল উদ্দেশ্য নিছক আকর্ষক গল্প বলা নয়। এতে যেমন কোমল সাহিত্য রস রয়েছে, তেমনি রয়েছে কিছু কঠোর বাস্তবের ব্যবহারিক বিজ্ঞান ও স্বনির্ভরতা্ শিক্ষার প্রথম-পাঠ। বিজ্ঞান ওসাহিত্যেরএক সূক্ষ্মসংমিশ্রণ ঘটেছে এই গল্পে, যা সব শ্রেণির মানুষকে আকৃষ্ট করবে। যদিও উপন্যসের স্বল্প পরিসরে এই বিষয়গুলো খুব সংক্ষেপে বলা হয়েছে, আশা করা যায়, পাঠক-পাঠিকারা নিদেনপক্ষে অবশ্যম্ভাবী বিপদ ও তাদের প্রতিকারের উপায় জানতে ও চিনতে শিখবে। তারা জানবে সেই বিপদগুলো কী ভয়ানক হবে এবং এগুলো এড়ানো্ বা মোকাবিলা করার জন্য এখন থেকে কী করা, বা না করা, দরকার। যাঁরা এই তথ্যগুলো জানবেন, তাঁরা জনসাধারণের মধ্যে এই বক্তব্যগুলো প্রচার করতে পারেন।

 

বইয়ের মুখবন্ধ (প্রিফেস)

 

জানিনা, আমার মতো একজন কাঠখোট্টা হার্ডকোর ইঞ্জিনিয়ার, যেকি না চার দশক ধরে শুধু মেশিন, বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার, যন্ত্রপাতি, সূক্ষতা ও দক্ষতা বিচার, বড় বড় যোজনা ইত্যাদি নিয়ে কাজ করেছে, সে কি করে উপন্যাস লেখার মতো ভীতিপ্রদ একটা কাজে জড়িয়ে পড়তে পারে।

কর্মজীবনে আমি কিছু নামজাদা ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানির সাথে কাজ করেছি যারা পৃথিবীর নানান দেশে বিস্মযঙ্কর প্রযুক্তি ও যোজনা তৈরি করেছে। সেই সুবাদে আমি বিভিন্ন দেশে বাস করার ও সেখানের সংস্কৃতি, অর্থনীতি, সামাজিক ব্যবস্থা, লোকজন ও পারিবেশকে চেনার সুযোগ পেয়েছি। সেই সব অভিজ্ঞতা ও তথ্যগুলি আমি মনের কোটরে জমিয়ে রেখেছিলাম, ভবিষ্যতে কাজে লাগতে পারে এই ভেবে। এখন সেগুলোকে নাড়াচাড়া করিও কিছু সমাজসেবা মূলক কাজ করারভাবনা চিন্তা করি।

প্রায় এক দশক আগে ঐ সব সংগৃহীত উপাদানের সাথে বিজ্ঞানের সত্যকে মিশিয়ে আমার এই অভিনব নভেল লেখার কাজটাশুরু করেছিলাম। উদ্দেশ্য ছিল, সাধারণ মানুষকে বিজ্ঞানের আবশ্যিক জ্ঞান বিতরণ করা। আমি বুঝেছিলাম, সাধারণ মানুষের অনেকেই বিজ্ঞান, প্রযুক্তি এবং সংখ্যা রাশির কচকচি এড়িয়ে চলে।তাই তাদেরকে আগ্রহীকরার জন্য আমি এই গল্প-উপন্যাসটা ফেঁদে ছিলাম।

***

আমরা, হোমো সেপিয়েন্স, মানে বিবর্তনের জ্ঞানবৃদ্ধরা, পৃথিবীর সমস্ত জীবকে পিছনে ফেলে এগিয়ে এসেছি। আমরা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি তৈরি করেছি যা আমাদের গুহা-মানবের আদিম অস্তিত্ব থেকে আধুনিক সভ্যতায় নিয়ে এনেছে। আমরা মেশিন উদ্ভাবন করেছি যা আমাদের জন্য কাজ করে, ওষুধ ও চিকিৎষা আবিষ্কার করেছি যা রোগ নিরাময় করে,উন্নত অস্ত্র তৈরী করেছি যা আমাদের হিংস্র জানোয়ার ও শত্রুদের হাত থেকে রক্ষা করে। আমরা চাষবাস, ফসল ফলান, কাপড় বু্না,প্রতিকূল আবহাওয়া এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে নিজেদের বাঁচাবার জন্য আশ্রয়স্থল তৈরি করাশিখেছি।

কিন্তু তারই পাশাপাশি, আমরা বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির অভিশাপগুলিও পেয়েছি─ যুদ্ধ, গণহত্যা ও চরম ধ্বংসকারী অস্ত্র তৈরীর কৌশলও শিখেছি। আমাদের স্বজনহনন, হিংসা, লুঠতরাজ, হাইজ্যাকিং ইত্যাদির মানসিকতা বন্য জন্তুদের হিংস্র প্রবৃত্তিকেও বহুগুণেহার মানায়। আমরা প্রায়ই ভুলে যাই যে পৃথিবীর সব পশুপাখি, প্রাণীও উদ্ভিদের আমাদের মতইএই গ্রহে সহাবস্থানের অধিকার আছে। আমারা, সভ্য মানুষরা, তাদের প্রতিপ্রায়ই যে নিষ্ঠুর ব্যবহার করি তা ক্ষমার অযোগ্য।

এছাড়া, আমাদের জীবনকে সহজ এবং আরামদায়ক করার তাগিদে আমরা বন জঙ্গল, গাছপালা কেটে শহর বিস্তার করছি, আবাদি জমিও নিস্তার পাচ্ছে না। পৃথিবীতে মানুষ এবং গবাদি পশুর সংখ্যা দিনদিন বাড়ছে,ফলে আমাদের চাষআবাদযোগ্য জমি ও জলের চাহিদাও বেড়ে চলেছে। পৃথিবীর বিশাল সমুদ্রে জলের প্রাচুর্য দেখে আমাদের জলেরস্বচ্ছলতা সম্বন্ধে একটা ভ্রান্ত ধারণা তৈরী হয়। কিন্তু এই জল সবটাই লোনা (স্যালাইন, প্রায় শতকরা সাড়ে তিন ভাগ দ্রবণীয় লবণ), আমাদের ব্যবহারের অযোগ্য। মানুষ ও অন্যান্য স্থলজীবি প্রাণী এবং উদ্ভিদের চাই মিষ্টি জল,যা ক্রমশঃ দুর্লভ হচ্ছে। আমাদের নদী, হ্রদ এবং ভূগর্ভস্থ জলভান্ডার (অ্যাকুইফার) থেকে আতি মাত্রায় জল নিষ্ক্রমন করার ও দূষণের ফলে সেখানেও ব্যবহার যোগ্য জলের যোগান ভয়াবহ ভাবে কমে যাচ্ছে।

পৃথিবীর অনেক জায়গায় পানীয় এবং সেচের জলের তীব্র অভাব দেখা দিচ্ছে, দুর্ভিক্ষ ও মহামারি হচ্ছে। প্রতি বছর হ্রদ ও পুকুর শুকিয়ে যায়, ভূগর্ভস্থ জলের স্তর নিচে নেবে যায়। উর্বর খেত ও গোচারণ ভূমি ও বনাঞ্চল মরুভূমিতে পরিণত হয়। ফসল শুকিয়ে যায়, দুর্ভিক্ষ এবং রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে। প্রতি গ্রীষ্মে পৃথিবীর অনেক শহরের বাসিন্দারাজলাভাবে অন্যত্র যেতে বাধ্য হয়, অথবা ভীষণ জলকষ্টে ভুগতে হয় (ভারতের মুম্বাই, চেন্নাই, দিল্লি, রাজস্থান ও গুজরাটের অনেক শহর, উত্তর আমেরিকার এরিজোনা ও নেভাদা অঞ্চল, দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউন, ইত্যাদি প্রত্যক্ষ উদাহরণ)।

এই সংকটের বৈজ্ঞানিক কারণ হল,সেই অঞ্চলের জলের চাহিদা সেই অঞ্চলের জলবিভাজিকা্র অন্তর্গত এলাকায় (ইংরাজিতে বলে ওয়াটার শেড) যে বৃষ্টিপাত (ওপাহাড় থেকে বয়ে আসাতুষারগলা জল) হয় তার পরিমানকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে। বিজ্ঞানের পরিভাষায় একে বলে, প্রকৃতির জল পূর্ণ করার ক্ষমতা (বা রিচার্জ রেট) প্রকৃতির জলচক্রের (নেচার্চ’স ওয়াটার সাইকেল) বাইরে চলে যাচ্ছে, অথবা সেই জল সংগ্রহ করে ধরে রাখার ক্ষমতাকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে।
যেহেতু জনসংখ্যা ক্রমবৃদ্ধিমান এবং তা নিয়ন্ত্রণকরা দুঃসাধ্য, আমরা শুধুমাত্র অপচয়, লিকেজ, অপ্রয়োজনীয় ব্যবহার এবং খোলা জলের উপরিতল থেকে বাষ্পীভবন কমাবার চেষ্টা করে আমাদের জলের সামগ্রিক ঘাটতিখানিকটা কমাতে পারি।

যেখানে সম্ভব, বৃষ্টির জল সংগ্রহ (রেইনওয়াটার হারভেস্টিং) ওসংরক্ষণ করতে পারি। বিশেষতঃ, শহরাঞ্চলের আবাসন, পাকাঘর বাড়ি, রাস্তা, বাঁধান জায়গা ইত্যাদি থেকে আসা বৃষ্টির জল, মূলতঃ পরিষ্কার ও দূষণমুক্ত। সেই জল সহজে সংগ্রহ করা যেতে পারে। ন্যূনতম পরিষোধন করলেই এই জল ভাল মানের ব্যবহার যোগ্য জল হবে। স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী জল সঞ্চয় করে রাখারও কিছু আধুনিক পদ্ধতি আছে, যা উপযোগ ক্রতে পারি। এই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাগুলি তাড়াতাড়ি করা দরকার। তা না হলে অদূর ভবিষ্যতে আমাদের ক্রমবর্ধমান শহরগুলিতে ও পৃথিবীর অনেক জায়গায় চরম জলসঙ্কট দেখা দেবে। অনেক সবুজ অঞ্চল অচিরেই প্রাণী ও গাছপালাহীন ধূসর মরুভূমিতে পরিণত হবে।

দুর্ভাগ্যবশতঃ, পৃথিবীর সর্বত্রবৃষ্টি ও বরফ গলা জলের মাধ্যমে প্রকৃতির জল বন্টনের মাত্রাসুসম নয়। ফলে,কিছু এলাকায় লাগাতার খরা ও জলের অভাব দেখা দেয়,আবার অন্য কিছু জায়গায় অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত, তুষার গলা জল অথবা নদীর উপরের বাঁধ থেকে ছাড়া অতিরিক্ত জল নিচের সমতলে বন্যা ঘটায়। এই সমস্যা অনেকাংশে সমাধান করা সম্ভব যদি আঞ্চলিক, প্রাদেশিক বা জাতীয় নদী গুলোকে যুক্ত করে,খাল কেটে ও বড় বড় পাইপ বসিয়ে নদী সংযোগ বা অন্তর্জাল (রিভার ওয়াটার নেটওয়ার্ক) তৈরী করা যায়। প্রয়োজন মত, কোথাও কোথাও খালের পরিবর্তে পাইপ ব্যবহার করলে জলের উপরিতল থেক বাষ্পীভবন জনিত ক্ষয় অনেকটা কম করা যায়।তাছাড়া পাইপ ব্যবহার করলে, নিচু জায়গার অতিরিক্ত বন্যার জল প্রয়োজন মত উঁচুতে থাকা ঘাটতিযুক্ত অঞ্চলে পাঠান সম্ভব হবে। এর জন্য কিছু এলাকায় বড় বড় পাম্পিং স্টেশন স্থাপন করা দরকার হবে।

উদ্বৃত্ত-এলাকার জল ঘাটতি-এলাকায় পাঠিয়ে সেখানে জমিয়ে রাখা সম্ভব হবে। বার্ষার অতিরিক্ত জলভূগর্ভস্থ স্তর গুলিতে পাম্প করে (ইনজেক্ট)করে রাখা যেতে পারে। সেই জলপরে পাম্প করে বার করে ব্যবহার করা যাবে।। এই জল সংযোগ গুলি (নেটওয়ার্ক) জনসাধারণ ও মাল পরিবহনের জন্যও ব্যবহার করা যেতে পারে -এর ফলে রাস্তার উপর চাপ কমবে ও পেট্রোলজাত জ্বালানিরও সাশ্রয় হতে পারে। এই নেটওয়ার্কগুলি আধুনিক কম্পিউটার, সফ্টওয়ার, নজরদারি সিস্টেম (এস-এম-সি ও স্ক্যাডা) দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এবং পরিচালিত হতে পারে। তার ফলেসুসম জল বন্টন এবং বন্যা নিয়ন্ত্রণসম্ভব হবে।স্থানীয় আবহাওয়া ও পরিবেশ বিভাগের সাথে সংযোগ রেখে কম্পুটারের সাহায্যে আগাম বা তৎকালীন প্রণালী (প্রেডিক্টিভ ও প্রেসেন্ট অপেরাটিভ মোডে) ব্যবহার করেআশু বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাষ, বিভিন্ন অঞ্চলে জলের প্রয়োজনের তথ্য সংগ্রহ করে উপযুক্ত স্বিদ্ধান্ত ও ব্যবস্থা নেওয়া যাবে।

তেল ও জ্বালানির পরিস্থিতিও অনিশ্চিত। আমাদের অটোমোবাইল এবং বিমান চলাচল প্রায় সম্পূর্ণই অপরিশোধিত পেট্রোলিয়াম তেল থেকে উৎপন্ন তরল জ্বালানির উপর নির্ভরশীল। অপরিশোধিত তেল ক্রমশ দুর্লভ এবং দামি হচ্ছে। আমাদের তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলি বেশিরভাগই কয়লা ব্যবহার করে। তেল এবং কয়লা মিলিতভাবে বিশ্বের জ্বালানি চাহিদার ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ মিটায়। তেল এবং কয়লা উভয়েই জীবাশ্ম জ্বালানি,তাতে প্রচুর পরিমাণে কার্বন থাকে। এগুলো পুড়লে, বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাইঅক্সাইড, কুখ্যাত গ্রীণ হাউস গ্যাস (জি-এইচ-জি) নির্গত হয় যা বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রধান কারণ। বর্তমানে, সৌর, বায়ু এবং হাইড্রোজেনের মত বিনা-কার্বন বাস্বল্প-কার্বনযুক্ত পুনঃ-নবীকরণযোগ্য (রিনিউএবেল) শক্তির সন্ধান বিশ্বব্যাপী চলছে। যদিও সমস্ত জীবাশ্ম জ্বালানি প্রতিস্থাপন করার সম্ভাবনা এখনও সুদূর পরাহত।কিছু অসাধু ব্যবসায়ী অবশ্য ইতিমধ্যে সবুজ-শক্তি বা জ্বালানি বা তার দ্বারা চালিত সবুজ-যানবাহন নামেমিথ্যা ধুয়ো দিয়ে নিজেদের সিদ্ধি সাধন করছে।

বিশ্বের অনেক জায়গায় প্রাকৃতিক বন (রেইন ফরেস্ট) এবং বন্যপ্রাণীদের অবস্থা শোচনীয়। অত্যাধিক বনধ্বংস, নগর সম্প্রসারণ, পর্যটন, অবৈধ শিকার এবং চোরাশিকারের ফলে বন্যপ্রাণী হ্রাস পাচ্ছে। দুঃখের বিষয়, অনেকগুলি বিরল ও বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতিও এর মধ্যে রয়েছে।

পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশীয় সরকার জল, জ্বালানি, বন্যপ্রাণী, পরিবেশ সুরক্ষা, উষ্ণায়ন ইত্যাদি সম্পর্কিত আইন ও কর্মসূচি নিয়েছে। কিন্তু জনসাধারণের কল্যাণের উদ্দেশ্যে নেওয়া এইসব কর্মসূচি সম্ভব  সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়া সফল করা সম্ভব নয়।আর তার জন্য সবার আগে দরকার জনগনকে এইসব সমস্যা, এদের কুপ্রভাব, সমাধানের উপায় ও প্রকল্পগুলি সম্বন্ধে অবহিত করা। জল ও তেলের অভাব, জীবাশ্ম জ্বালানি, গ্রীণহাউস গ্যাস, বিশ্ব উষ্ণায়ন জড়িত সমস্যা গুলি আসলে কি এবং এরা কি বিপদ ঘটতে পারে তা সবাইকে বুঝতে হবে। জনসাধারন এগুলি সম্বন্ধে জানলে এই সমস্যা গুলির অনেকটাই তারা নিজেরা সামাজিক আচার, ব্যবহার ও পরিবর্তণের মাধ্যমে সমাধান করে নিতে পারবে, যেমন জল অপচয় ও দূষণ বন্ধ করা, বৃষ্টিধারা সংগ্রহ করা ইত্যাদি। পুনঃ-নবীকরণযোগ্য শক্তি (উর্যা), জল সংগ্রহ এবং বন ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের প্রয়জনীয়তা ও সকলের জানা দরকার। এর জন্য সাধারণ মানুষের বিজ্ঞানের প্রাথমিক জ্ঞানথা কাটা দরকার।

 

গল্পের সংক্ষিপ্তসারঃ

 

একটি বিশ্ববিখ্যাত কর্পোরেট সংস্থার একজন সিনিয়র এক্সিকিউটিভ, ‘বস’ (গল্পের বর্ণনাকারী) এবং তাঁর একজন কনিষ্ঠ (জুনিয়র) কর্মচারীর মধ্যেএক অসম বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। দুজনের মধ্যে প্রায় এক প্রজন্ম বয়সের ব্যবধান ছিল। তাদের কোন পূর্ব-পরিচয় ও ছিল না। এই বন্ধুত্ব গড়ে ওঠার পিছনে প্রধান অনুঘটক ছিল একটা মর্নিং ওয়াকের ঘটনা।

বস ও কনিষ্ঠজন, দুজনেই তাদের ব্যক্তিগত জীবনের প্রথম পর্যায়ে হৃদয় বিদারক ঘটনার সম্মুখীন হয়েছিল। কিছু সন্ত্রাসবাদির একটি বিমানে বোমা বিস্ফোরণ ঘটায়, যেটাতে বস তাঁর দীর্ঘদিনের বাকদত্তা হবু-জীবন সঙ্গিনীকে হারান তাঁদের নির্ধারিত বিয়ের মাত্র কয়েকদিন আগে। কনিষ্ঠজন আজন্ম দক্ষিণ আফ্রিকায় বনাঞ্চলের কাছে এক শহরতলির সুখী পরিবারের সন্তান ছিল।তার বাবা বনবিভাগের কর্মনিষ্ঠ, সৎ অফিসার ছিলেন যিনি জঙ্গলে বেআইনী পশুহত্যাকারী ও পাচারকারীদের বাধা দিতে গিয়ে তাদের গুলিতে মারা যান। মাত্র চোদ্দ বছর বয়সে সে নিজেদের ঘরবাড়ি ও দেশ থেকে বিতাড়িত হয়ে উদবাস্তু হয়ে কানাডায় এসে আশ্রয় নেয়। এই অপঘটনের ফলে,মানুষ সমাজের প্রাকৃতিক ন্যায় বিচারেরর উপর এদের দুজনেরই আস্থা চলে যায়।

কনিষ্ঠজন তার যুবকোচিত মনোভাব ও ইতিবাচক প্রেরণার ফলে অল্প সময়ের মধ্যে তার ব্যথা ভোলার জন্য মনকে শক্ত করে। সেকিছু বন্ধু ও লোকজনদের নিয়ে একটা প্রাতঃ ভ্রমনের দল তৈরী করে, যার নাম দেয় মর্নিং ওয়াকারস ক্লাব। তারা প্রাতঃভ্রমনের মধ্যে দিয়ে স্বাস্থ্য ও মনের যত্ন নিতে থাকে ও তার সঙ্গে অনেক সমাজ সেবামূলক কাজে নিজেদের নিয়োযিত করে।

তাদের কর্মকাণ্ড শীঘ্রই তাদের ও তাদের আশেপাশের শহরে একটি সামাজিক আন্দোলনে পরিণত হয়। দলটি পৃথিবীতে ক্রমবর্ধমান মিঠা জলের অভাব, জ্বালানি সংকট, পরিবেশ দূষণ রোধ করাও তার সঙ্গে প্রাকৃতিক বন এবং বন্যপ্রাণীদের রক্ষার জন্য প্রত্যক্ষ প্রচার ও কাজ করার সংকল্প নেয়।

কিন্তু, দলটি উপলব্ধি করে তাদের তাৎক্ষণিক অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত পৃথিবীতে অসন্ন ভয়বহ মিষ্টি জলের অভাব মোকাবেলা করতে। তারা জানে, পানীয় ও সেচের জলের অভাব হলে চরম দুর্ভিক্ষ ও মহামারী দেখা দেবে। জলের সংকট ইতিমধ্যে বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় দেখা দিচ্ছে, যার ফলে মানুষ এবং গবাদি পশুর মৃত্যু এবং রোগ দেখা দিয়েছিল। প্রতি গ্রীষ্মে, অনেক শহর খালি করা হয়। অনেক সবুজ বেল্ট মরুভূমিতে পরিণত হচ্ছে। দলটির প্রচারাভিযানের প্রধাণ উদ্দেশ্য ছিল জনগণকে এই বিষয়ে শিক্ষিত করা। জনগনকে বুঝাতে হবে যে তাদের জলের অতি ব্যবহার এবং অপচয় বন্ধ করতে হবে। তার সঙ্গে তাদের জলের দূষণও এড়াতে হবে।

জনগনকে বৃষ্টির জল সংগ্রহ করা এবং সেচ ব্যবস্থাকে আধুনিকীকরণ করার পরামর্শও দেওয়া। লোকের বোঝা দরকার খোলা চাষের জমিতে বর্তমান প্রথায় সেচ করলে জলের অনেকটাই বাষ্পীভূত হয়ে হারিয়ে যায়। সেখানে গাছের গোড়ায় জলের ড্রিপার চালু করা যায় কি না খতিয়ে দেখা দরকার।

কিন্তু, প্রবীণ বস দুই দশকেও তার মানসিক আঘাত কাটিয়ে উঠতে পারেননি। তিনি চরম হতাশায় ভুগছিলেন। এই দুই প্রবীণ ও নবীনের বন্ধুত্ব তাদের জীবনে একটি নতুন অমৃতের স্বাদ এনে দেয়। কনিষ্ঠজন এবং তার বাকদত্তা এক উচ্ছল যুবতী প্রবীণ বসকে তাদের সাথে মর্নিং ওয়াকারক্লাবে যোগ দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানায়। তাদের বন্ধুত্বের জোরে বস আবার স্বাভাবিক জীবনের ভাঁজে ফিরে আসেন এবং তাঁর হারিয়ে যাওয়া সুখ ফিরে পান।

উপাখ্যান গুলির মধ্যে রয়েছে একটি বীভৎস সন্ত্রাসী হামলা এবং তার পরবর্তী করুণ ঘটনাবলী, অপরাধ, ষড়যন্ত্র, অহং, ঘৃণা, নিষ্ঠুরতা এবং পাশাপাশি, মানুষ, প্রাণী, প্রকৃতি এবং পরিবেশের প্রতি গভীর মমতা ও ভালবাসা। আসন্ন জল ও অন্যান্য সংকট এবং কীভাবে আমাদের এই সবুজ গ্রহকে বিপদ থেকে বাঁচান যায় তারই বার্তা উপন্যাসের মধ্যে মৃদু ভাবে ঘুরছে। কিছু প্রাথমিক বৈজ্ঞানিক তথ্যে ও কল্পকাহিনির শৈল্পিক মিশ্রণ গল্পটিকে একটি মসৃণ সমাপ্তিতে নিয়ে যায় যাতে পাঠকদের কল্পনাবিস্তারের যথেষ্টঅবসর রয়েছে।

 

মর্নিং ওয়াক’ নাম করণের যৌক্তিকতাঃ

‘মর্নিং ওয়াক’ নামটারূপকার্থে ব্যবহার করা হয়েছে, যদিও গল্পের মধ্যে এর একটা বাস্তবিক ভূমিকা আছে। প্রাতঃভ্রমণের (মর্নিং ওয়াকের) সময় ও পরিস্থিতিটা (উষাক্ষণ) এমন হয় যে তখন সকলের মনে প্রাণে একটা সম্ভাবনাময় নতুন দিনের আগমন বার্তা আসে, এক অবর্ণনীয় অনুভূতি সৃষ্টি করে। প্রাতঃভ্রমণ একটি সামান্য কাজ যা নিখরচায় প্রত্যহিক কাজের মতন যে কেউ করতে পারে। বন্ধুবান্ধব ও পরিচিত জনদের সাথে দলবেঁধে  নিয়মিত প্রাতঃভ্রমণ করলে অভাবনীয় শারীরিক এবং মানসিক উপকার পাওয়া যায়। তাছাড়া, দিনের শুরুতে এই রকম একটা উপভোগ্য ও আনন্দদায়ক কাজ করলে, সারাদিন অফুরন্ত মানসিক শক্তি ও উদ্দিপনা বজায় থাকে। ফলে,সকল বাধা বিপত্তিও সহজ মনে হয়।

পুরুষ, মহিলা, ধনী, দরিদ্র, তরুণ, বৃদ্ধ, যে কেউ নিজের সামাজিক বা পেশাদারী আত্মম্ভরিতা ভুলে দলবদ্ধ প্রাতঃভ্রমণে যোগ দিতে পারে – কোন টাকা পয়সা বা অনুমোদনের দরকার হয় না। দীর্ঘ সময় একসাথে চলার ফলে একে অপরকে কাছ থেকে জানার ও চেনার সুযোগ পায়। সবাই নিজের নিজের সুখ, দুঃখ, আনন্দ ও বেদনার কথাগুলো অন্যদের সাথে ভাগ করে নিতে পারে।

এই প্রাতঃভ্রমণের দলে বিভিন্ন পেশার ও বৈজ্ঞানিক-কারিগরী দক্ষতা ও অভজ্ঞতাপূর্ণ সভ্য থাকার ফলে, তারা সঙ্গবদ্ধ ভাবে দেশের ও সমাজের উন্নতির, সমস্যার ও বড় সমাজ সেবামূলক কাজে করার কথাও চিন্তা করতে পারে। স্বতপ্রণোদিত হয়ে অনেক ছট বড় পরিকল্পনাও হাতে নিতে পারে।

****

বইটি কিনতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন

Leave a Comment