বন্ধুদের লেখা

টবে সবজি করা। জৈব সারের ব্যবহার

টবে সবজি করা। জৈব সারের ব্যবহার।

কলমেঃ অনুপম মজুমদার

লেখক পরিচিতিঃ

অনুপম মজুমদারঅনুপম বাবু ছাদ বাগান এবং কম্পোস্টিং বিশেষজ্ঞ।

 

—————————————————————————————————————

ফসফেট

আজকাল অনেকে টবে সবজি করছেন। কিন্তু নানা প্রকার সমস্যায় পড়ে একটু হতাশ হচ্ছেন। তাই জৈব সারের প্রয়োগ সম্পর্কে দু চার কথা। সবটাই আমার অভিজ্ঞতা বা বলতে পারেন, ঠেকে শেখা। প্রায় সকলেই সরষের খোল, নিম খোল আর কম্পোস্ট ব্যবহার করেন। তাতে বেশির ভাগ সবজির ক্ষেত্রে নাইট্রোজেনের অভাব হয় না, কিন্তু পটাশিয়াম ও ফসফেটের অভাব হয়। এছাড়া সালফার, ম্যগনেশিয়াম, ক্যালশিয়াম এবং মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট এর অভাব হয়। এই সমস্যাগুলি কি করে সমাধান করা যায় সে সম্পর্কে দু চার কথা বলব। আজকের বিষয় ফসফেট।

সাধারনত ভাজা হাড়ের গুঁড়ো ব্যবহার করা হয় ফসফেটের জন্যে। স্টিমড বোন মিলএ থাকে ৩ ভাগ নাইট্রোজেন, ১২-১৪ ভাগ ফসফেট আর একটু ক্যালশিয়াম।  আমি হাড়ের গুঁড়ো গাছ বসাবার সময় মাটির সংগে মিশিয়েছি। লক্ষ্য করেছি গাছে ফসফেটের অভাব কমে নি। কারন কি?
সাধারনত সমস্ত সবজি গাছের আয়ু ৩/৪ মাস। সেই সময়ের পরে টবের মাটি খুলে দেখেছি মাটির সংগে প্রচুর হাড়ের গুঁড়ো, গুঁড়ো আকারেই রয়ে গেছে। অর্থাৎ গাছ সেই সার নিতেই পারে নি।

কেন? কারন হাড়ের গুঁড়ো মাটির সংগে মিশে গাছের খাদ্যে পরিনত হতে সময় লাগে কমপক্ষে চার মাস। এবং যদি মাটির ph ছয়ের আশে পাশে থাকে তবেই সেটা সম্ভব। কিন্তু যে সবজি গাছের আয়ু মাত্র তিন চার মাস তার ক্ষেত্রে বোনমিলের ব্যবহার তাহলে কি ভাবে করা যায়? উত্তরটা হল, বোনমিলকে খাদ্যে রুপান্তর করে টবের মাটিতে মেশাতে হবে। তার একাধিক উপায় আছে। প্রথমে বলি চটজলদি একটা উপায়। ১০০ গ্রাম স্টিমড হাড়ের গুঁড়ো এক লিটার জলে ফুটিয়ে সেই জলটা ঠান্ডা করার পরে সেটা নেকড়ায় ছেঁকে সেই জলটা ব্যবহার করলে সেটা খুব দ্রুত মাটিতে গাছের খাদ্যে রুপান্তরিত হয়।
দ্বিতীয় উপায়। ৫০ ভাগ কম্পোস্ট আর ৫০ ভাগ মাটির সংগে হাড়ের গুঁড়ো মিশিয়ে একটা টবে ছ মাস রেখে দিন। দেখবেন যেন মাটির পি এইচ কখনো ৬.৫ এর উপরে না থাকে।নিয়মিত অল্প জল দিতে হবে। (পি এইচ নীচে নামানোর সরল উপায় লেবুর খোসা জলে ভিজিয়ে রেখে সেই জলের সংগে কলের জল মিশিয়ে দেয়া)।  ৬ মাস পরে দেখেছি হাড়ের গুঁড়োর আলাদা কোন অস্তিত্ব থেকে না। এবারে সেই মাটি টবের মাটির সংগে অল্প করে মিশিয়ে দিলে ফসফেটের অভাব একেবারে হবে না। এখানে একটি কথা বলা দরকার। কখনো হতাশ হয়ে সুপার ফসফেট ব্যবহার করবেন না। কারন ওটাও বাস্তবে জলে গোলে না। সামান্য একটু খানি জলে গুলে গাছের খাদ্য হয় কিন্তু বাকীটা মাটিতে আটকে থেকে যায় বহুকাল। যত রকমের সিন্থেটিক সারের ব্যবহার হয় তার মধ্যে সুপার ফসফেট সব থেকে সব্বোনেশে।
—————————————————————————————————————

পটাশিয়াম

খাঁটি নিম খোল সহজে পাওয়া যায় না। কি ভাবে চিনবেন? এক মুঠো নিয়ে একটা কাঁচের পাত্রে জলে দিলে খানিক পরে গ্লাসের নীচে যে সেডিমেন্ট পড়বে সেটার রং হবে হলুদ আর জলের রং হবে কালো। বুঝবেন খাঁটি।

পটাশিয়াম গাছের জন্য কেন দরকার সেটা সকলে জানেন। তবু দুটি কথা বলি। পটাশিয়ামের অভাব থাকলে গাছের খাবার তৈরি ঠিক ঠাক হয় না। আর অসুখ বিসুখ বাড়ে। পোকা মাকড়ের আক্রমন বেশি হয়। বাস্তবে নাইট্রোজনের পরেই পটাশিয়ামের স্থান। বেশির ভাগ গাছের জন্যে নাইট্রোজেন ও পটাশিয়াম সমান মাত্রায় লাগে, কোন কোন ক্ষেত্রে কম বেশি। কিন্তু আমাদের জৈব সারের মধ্যে পটাশিয়াম অতি কম মাত্রায় পাওয়া যায়। দরকারের থেকে অনেক কম। তাহলে কি উপায়ে পটাশিয়ামের অভাব দূর করা যায়?

একটা কলার খোসায় ৭৮ মিলিগ্রামের মতন পটাশিয়াম থাকে। একটা গোটা কলায় ৫০০ মিলিগ্রাম পটাশিয়াম থাকে।  এবারে একটা একটা গাছের জন্যে কতটা করে পটাশিয়াম লাগবে জানা থাকলে কতগুলি কলার খোসা লাগবে তা জানা হল। এই কলার খোসা টুকরো করে কেটে জলে ভিজিয়ে রেখে ৭ দিন পর পর সেই জল গাছের গোড়ায় দিলে সেটা দ্রুত খাদ্য হিসেবে নিতে পারবে গাছ। এত কলার খোসা যোগাড় করা কঠিন। সেক্ষেত্রে যদি কেমিক্যাল সার ব্যবহার জরুরী হয় তাহলে পটাশিয়াম সালফেট ব্যবহার করা যায়। খুব হিসেব করে। খুব সামন্য পরিমান করে কয়েক দফায়।  পটাশিয়াম সালফেট মাটির মাইক্রোবদের ক্ষতি করে না। এবং গাছের জন্য খুব জরুরী সালফার গাছ পেয়ে যায়। তাছাড়া এতে ক্লোরিন খুব কম থাকে। কিন্তু কখনই লাল রঙের মিউরেট অব পটাশ ব্যবহার করবেন না। ( এটা নেহাৎ আমার ব্যক্তিগত অভিমত)। এছাড়া পেঁয়াজের খোসা ব্যবহার করা যেতে পারে। বাজারে যারা পেঁয়াজ বেচে তারা প্রচুর খোসা ফেলে দেয়। সেগুলি তাদের কাছ থেকে নিয়ে গাছের গোড়ায় মালচিং করলে, গাছ একটু পটাশিয়াম এবং অনেকগুলি মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট অল্প পরিমানে পাবে।
—————————————————————————————————————

ম্যাগ্নেশিয়াম, সালফার ও ক্যালসিয়াম।

কাঁচা গোবরে কি আছে?

৩%নাইট্রোজেন, ২%ফস্ফেট আর ১% পটাশিয়াম এবং প্রচুর এমোনিয়া আর প্যাথোজেন। এই প্যাথোজেন ভয়ানক বিপজ্জনক।
গোমূত্রের প্রধান সার হল ২.৫% ইউরিয়া। তাই গোমুত্রের ব্যবহারে গাছ হুড়মুড়িয়ে বাড়ে।এই দুইএর ব্যবহার এখন জোর কদমে হচ্ছে। সুফল কুফল বুঝতে সময় লাগবে।

ম্যাগ্নেশিয়াম, সালফার আর ক্যালসিয়ামকে secondary nutrients বলে, এটা সকলে জানেন। কিন্তু এই তিনিটি বস্তু যতটা পরিমানে গাছের দরকার ততটা প্রচলিত জৈব সারের মধ্যে পাওয়া যায় না। নিম খোল, সরষের খোল, কম্পোস্ট সবার মধ্যেই একটু একটু ম্যগ্নেশিয়াম আছে, নিমখোলের মধ্যে একটু সাল্ফারও আছে কিন্তু অনেক সবজি গাছের জন্য সেটা যথেষ্ট নয়। সেক্ষেত্রে এক চামচ করে epsom salt বেশ কার্যকরি। এর মধ্যে ১০% ম্যাগ্নেশিয়াম আর ১৩% সাল্ফার আছে। এবং এটি একটা খনিজ পদার্থ। একে জৈব বলবেন কি না সেটা আপনার ইচ্ছে। তবে এটাকে আমি প্রাকৃতিক বস্তু মনে করি। তাই জৈব সার বলেই মেনে নিয়েছি। এই এপসম সল্টে ম্যাগ্নেশিয়াম ও সাল্ফার, দুই এর অভাবই পুরন করা সম্ভব।

এবারে ক্যালশিয়াম। গোড়াতে বলি ম্যগ্নেশিয়াম আর ক্যালসিয়ামের মধ্যে সম্পর্ক খুব ভালো না। একটা বেশি হলে অন্যটা কাজ করে না। সুতরাং এর মাপ ও ব্যবহার একটু হিসেব করে করতে হয়। জৈব ক্যলসিয়ামের সবথেকে বড় সঞ্চয় রয়েছে ডিমের খোলায়, ৪২%। এটা ব্যবহার করার কিছু বিশেষ উপায় আছে।
কম্পোস্টে ডিমের খোলা দিলে সেটা ডিকম্পোজ হতে বছর পেরিয়ে যেতে পারে। তাই সব থেকে সহজ উপায় হল ডিমের খোলা জমিয়ে সেগুলো মিক্সার গ্রাইন্ডারে গুঁড়ো করে নেয়া। দেখবেন একেবারে মিহি হয়ে যাবে। এবারে সেই গুঁড়ো এক লিটারের এক বোতল জলে ( ph 6 এর আশে পাশে) এক চামচ দিয়ে সাত দিন রাখলে ডিমের খোলা দেখা যাবে না। সেই জল ব্যবহার করা।

আর একটা কথা। ডিম সেদ্ধ যদি জলে ফুটিয়ে করেন ( মেসিনে না করে) তবে সেই জলটা ফেলে দেবেন না। একটা পাত্রে রেখে ঠান্ডা করে গাছের গোড়ায় দিন। গাছ খুব আনন্দ পাবে, ঐ জলেও প্রচুর ক্যালসিয়াম আছে।

এবারে মাপ। ম্যাগ্নেশিয়াম আর ক্যলসিয়ামের মধ্যে সম্পর্কটা হল সঠিক পরিমানের। তার হের ফের হলেই একজন অন্যজনকে কাজ করতে দেয় না।। মাপের হিসেব হল ১ঃ৩ অর্থাৎ ম্যাগ্নেশিয়ামের তিন গুন ক্যালশিয়াম।
এবারে ১ চামচ বা ৫ গ্রাম এপ্সম সল্টে ১০% ম্যাগ্নেশিয়াম আছে। আর ডিমের খোলায় ৪২% ক্যালশিয়াম আছে। কিন্তু ডিমের খোলার গুঁড়ো এক চামচ ত ৫ গ্রাম হবে না। ওটা খুব হাল্কা। তাহলে মাপ কি করে হবে? ল্যাবে ব্যাপারটা অবশ্যই ঠিক করা সম্ভব। কিন্তু সে আমার কম্মো নয়। তাই এক চামচ এপ্সম সল্ট দিলে এক চামচ ডিমের খোলার গুঁড়ো কাজ করবে। ক্যালসিয়াম এর ব্যবহার নিয়ে আরো কিছু কথা আছে। পরে যখন মাটিতে সারের মোবিলিটি নিয়ে আলোচনা করব তখন। বাস্তবে ডিমের খোলার গুঁড়ো ব্যবহারের সব থেকে ভালো পদ্ধতি হল হাড়ের গুঁড়োর সংগে মিশিয়ে মাটি ও কম্পোস্টের মধ্যে ছ মাস রাখা।তারপরে সেই মাটি সার হিসেবে ব্যবহার করা
—————————————————————————————————————

মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টস বা অনুখাদ্য।

শীতের সবজি, কপি। ফুল, বাঁধা,ব্রোকলি। এদের পাতা ডাঁটা কিচ্ছু ফেলবেন না কিন্তু। এতে প্রচুর নাইট্রোজেন, ক্যালশিয়াম আর বোরন আছে। এগুলো অবশ্যই কম্পোস্টে দিন। গাজর ত গাছ শুদ্ধ পাওয়া যায় না। গাজরের পাতায় আছে পটাশিয়াম। কিন্তু গাজরের খোসাতেও পটাশিয়াম রয়েছে।

বোরন, জিংক,ম্যাংগানিজ, আয়রন, কপার, মলিবডিনাম ও ক্লোরিন এই সাতটা প্রধান মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট বা অনুখাদ্য। বোরন আর ক্যালসিয়ামের মধ্যে খুব বন্ধুত্ব। ওরা একসংগে মিলে মিশে কাজ করে। আবার অতিমাত্রায় ক্যালসিয়াম এবং নাইট্রোজেন হয়ে গেলে বোরন কাজ করতে পারে না।গাছের cell division এ বোরন ক্যালসিয়ামের সংগে মিলে কাজ করে। ফুল, ফল ও ফলের বীজ হবার জন্যে বোরন দরকার। গাছের ফুল ঝরে যায় তার অনেক কারনের মধ্যে বোরনের অভাব একটা। কিন্তু এই অনুখাদ্য লাগে একেবারে এক টিপ করে। বেশি হয়ে গেলে বিপদ, যাকে বলে বোরন টক্সিসিটি হয়ে যায়।
গাছের এঞ্জাইম ও প্রোটিন গ্রহন করার ক্ষমতা বাড়ায় জিংক। পাতাকে সবুজ রাখে জিংক সাল্ফেট। খুব কম মাত্রায় লাগে। কিন্ত দরকার। মাটির ph 6এর আশে পাশে না থাকলে এটা কাজ করে না। মাটিতে ফস্ফেটের পরিমান বেশি হলে এ কাজ করতে পারে না। ম্যাংগানিজ অত্যন্ত দরকার গাছের। কারন ম্যাংগানিজ গাছের খাবার তৈরি করতে লাগে। শ্বাস প্রশ্বাসের জন্যও লাগে। খুব কম পরিমানে লাগে। কিন্তু লাগে।

আয়রন ও কপারও ম্যাংগানিজের মতনই গুরুত্বপূর্ন। এবং প্রায় একই সংগে কাজ করে। মলিবডিনাম, নাইট্রোজেন ব্যবহারে সাহায্য করে। বাতাস থেকে নাইট্রোজেন নিতেও সাহায্য করে। তাছাড়াও এর কিছু কাজ আছে। যেমন টমেটো গাছে মিলিবডিনামের অভাব হলে ফল পাকতে চায় না। ক্লোরিন পাতার স্টোমাটা খোলা ও বন্ধ করার জন্যে দরকার। কিন্তু এটা আমাদের জলের মধ্যেই আছে। তাই আলাদা করে দিতে হয় না। আবার কিছু গাছ আছে যারা অতিমাত্রায় ক্লোরিন সহ্য করতে পারে না। যেমন অত্যান্ত চলতি সবজি লংকা গাছ।

এই সব বস্তগুলি কি অর্গানিক আকারে পাওয়া যায়? এক কথায় উত্তর না। কিছু কোম্পানী মিথ্যে কথা বলে বেশি দামে বেচে। কিন্তু সেগুলো মোটেই অর্গানিক নয়। সেগুলিও খনিজ। বাস্তবে এই খনিজ বস্তুগুলিকে সিন্থেটিক মনে করে ব্যবহার না করাটা ভুল বলে আমার মনে হয়েছে। ( অবশ্য আমার ধারনা ভুলও হতে পারে)। আমি ব্যবহার করে সুফল পাই। এবং আমার মাটি বেশ উর্বরা।

এবারে বলি সব গুলোতেই বলেছি খুব পরিমানে লাগে। কিন্তু কতটা? ঠিক উত্তর এক একটা সবজির জন্য এক এক রকম। কিন্তু গড় পড়তা হিসেব হল, একটা ১০ ইঞ্চি টবে করা গাছের জন্য এই সব মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টের মিশ্রন এক চামচ দিলেই হয়। কিন্তু একবারে এক চামচ নয়। গোড়ায় আধ চামচ। আর ফুল ধরার আগে আধ চামচ।

আরো পড়ুন

আমার কম্পোস্ট, রান্নাঘরের জঞ্জাল মুক্তি

Leave a Comment