বন্ধুদের লেখা

পশ্চিম বর্ধমান জেলার দুই ব্লক পড়তে পারে সবচেয়ে বেশি জল সংকটের মুখে

পশ্চিম বর্ধমান জেলার দুই ব্লক পড়তে পারে সবচেয়ে বেশি জল সংকটের মুখে

লেখক পরিচিতি : সোমনাথ কুমার দাস

Somnath Kumar Dasসোমনাথ কুমার দাস, বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভূগোলে স্নাতক। স্থানীয় অঞ্চলের বিভিন্ন ভূপ্রকৃতিক বিষয়, জল সম্পদ, এবং এর সাথে বিভিন্ন স্থানে নদীর উপত্যকা ও অববাহিকা সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ ও তার ব্যবহারিক ক্ষেত্র জানতে ও জানাতে আগ্রহী। সোমনাথের প্রিয় বিষয় জলবায়ু বিদ্যা (climatology) , সাথে নদী বিদ্যা ও।

 

 —————————————————————————————————————

সত্যি কি আগামী ২০৫০-৬০ এর মধ্যে  পশ্চিম বর্ধমান জেলার দুই ব্লক পড়তে পারে সবচেয়ে বেশি জল সংকটের মুখে

আঞ্চলিক সমীক্ষা করে এবং কিছু বাস্তব জ্ঞান দ্বারা বিষয়টি উপস্থাপন করছি —

আমাদের জেলা পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিম বর্ধমান , এবং তার সর্ব পশ্চিমে রয়েছে পাশাপাশি দুটি ব্লক – সালানপুর এবং বারাবনী।

ভূপ্রকৃতি (topography)

ক্ষুদ্র স্কেলের মানচিত্রে দেখলে পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিমের জেলা গুলোর মধ্যে পশ্চিম বর্ধমান এর এই ব্লক গুলো ভারতের ছোটনাগপুর মালভূমির পূর্বাংশের শেষ প্রান্ত। কিন্তু বৃহৎ স্কেলের মানচিত্রে খুব নিখুঁত ভাবে দেখলে দেখা হবে পশ্চিমের ছোটনাগপুর মালভূমির বিচ্ছিন্ন দুটি উচ্চভূমি যা দক্ষিণে সালানপুর উচ্চভূমি  এবং পূর্ব দিকে চলে গেছে বারাবনী উচ্চ ভূমি যা আজকের দুটি প্রথম ব্লক।

এই উচ্চভূমি অঞ্চল গুলো সাগর পৃষ্ঠ থেকে গড়ে ১৫০-১৭০ মিটার উচুঁ, যা সহজ ভাষায় নিম্ন মালভূমি(low land plateau) অংশ বলা চলে।এর মধ্যে সালান পুর উচ্চভূমির  সবচেয়ে পশ্চিমে ঝাড়খন্ড সীমানায় চিত্তরঞ্জন রেল শহর এর উচ্চতা সবচেয়ে বেশি, প্রায় ১৮০ মিটারের কাছাকাছি ।এই দুই উচ্চভূমি গুলো ধীরে ধীরে সালানপুর, সীতারাম পুর হয়ে ঢালু হয়ে আসানসোল (পশ্চিমবঙ্গের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর) শহরে নেমে গেছে, তাই আসানসোল শহরের জমি নিম্নভূমি বা সমতল জমির অন্তর্গত।

ক্ষুদ্র স্কেল ম্যাপে সমগ্র এলাকাটি একটি ব্যবচ্ছিন্ন মালভূমির জমি।

  • ওদিকে বারাবনী উচ্চভূমি নীচু হয়ে অজয় নদ উপত্যকায় মিশে গেছে,
  • আবার সালানপুর উচ্চভূমি পশ্চিম দিকে ঢালু হয়ে বরাকর নদ উপত্যকায় মিশেছে।
  • মাইথন এর কাছে দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশন (DVC) বাঁধ দিয়ে বরাকরের অতিরিক্ত জলকে আঁটকে বিরাট জলাধার গড়ে  তুলেছে তাই এই নদ এর জল আঁটকে আঁটকে  জলাধার এর জল অনেকটা আয়তন লাভ করেছে।

এখন এই উচ্চভূমি অঞ্চল গুলো দুই নদ এর মাঝে এক একটা জল বিভাজিকা রূপেই দাঁড়িয়ে আছে ( যে উচ্চভূমি বৃষ্টির ঝরে পড়া জল বিভাজন করে ফেলে এবং দুই নদী উপত্যকার মাঝে যে উচুঁ জমি থাকে)।

ভূতাত্ত্বিক গঠন (Geological structure)

সর্ব পশ্চিমে চিত্তরঞ্জন অঞ্চল ছোটনাগপুর মালভূমির প্রাচীন গ্রানাইট জাতীয় পাথর, বেলেপাথর,রূপান্তরিত কোয়ার্টজাইট এবং কোয়ার্টজ, ফেল্ডস্পার খনিজ সমৃদ্ধ। তবে দক্ষিণ দিকের গোটা সালান পুর , এবং পূর্ব দিকের বারাবনী অঞ্চলে প্রচুর পরিমাণে বিশুদ্ধ ও অবিশুদ্ধ বেলেপাথরের স্তর দেখা যায় এবং কোয়ার্টজাইট ও গ্রানাইট এর স্তর ভূগর্ভে অপ্রবেশ্য পাথর রূপে অবস্থান করে আছে।

মাইথন জলাধারের ধারে ধারে প্রচুর পরিমাণে সাদা কোয়ার্টজ খনিজ এবং গ্রানাইট এর টুকরো অংশ পড়ে থাকতে দেখা যায়।

সালানপুর ব্লক উচ্চভূমির রূপনারায়ণপুর অঞ্চলের বিরাট এলাকা জুড়ে বিশুদ্ধ বেলেপাথরের নীচে একটি কাদা সমৃদ্ধ বেলেপাথরের স্তর রয়েছে।এবং সামগ্রিক শিলাস্তরগুলো দক্ষিণ দিকে সামান্য হেলে একনত গঠন তৈরি করেছে (uniclinal structure)। কয়লা খনি গুলোর কয়লার স্তর গুলো দেখলেই বুঝতে পারবেন।

পশ্চিম বর্ধমান জেলার দুই ব্লক পড়তে পারে সবচেয়ে বেশি জল সংকটের মুখে2

জল নিষ্কাশন   ভূগর্ভের জল সঞ্চয় কেমন?

এই সালানপুর এবং বারাবনী উচ্চ ভূমি অঞ্চলে বৃষ্টির জল ঝরে পড়লে, প্রথমে চাদর প্রবাহ এবং পরে ছোটো নালা হয়ে — সালানপুর উচ্চভূমি থেকে গোটা এলাকার জল পশ্চিমে বরাকর নদ উপত্যকায় গড়িয়ে মাইথন জলাধারে মেশে, এবং কিছুটা জল পূর্ব দিকে গড়িয়ে অজয় নদ উপত্যকাতে মেশে।

অন্য দিকে বারাবনী উচ্চ ভূমির ওপর ঝরে পড়া বৃষ্টির জল কিছুটা অজয় নদ উপত্যকাতে গড়িয়ে যায় এবং বাকিটা নেমে আসে আসানসোল নিম্নভূমির ছোট নদী নালার দিকে।এর ফলে অতিরিক্ত বৃষ্টিতে মাইথন বাঁধ এবং অজয় নদ এ যতই জলস্তর বাড়ুক, এই ব্লক গুলোনে কোনোদিনও বন্যা ঘটে না এবং আগামী ১০০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে উচুঁ স্থান গুলো যেমন রূপনারায়ণপুর , চিত্তরঞ্জন শহর গুলোনে বন্যার হওয়ার  কোনো আশঙ্কা নেই।

কেবল অজয় নদ উপত্যকার স্থানীয় গ্রাম গুলো অতিরিক্ত জলে সামান্য প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে এটা বলা চলে।

তবে আসানসোল শহরের নিম্নভূমি অঞ্চলে ২০২১ ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতির বেসামাল দিশা দেখা দিয়েছে, এবং আগামী ভবিষ্যতে অতিরিক্ত বৃষ্টিতে শহরে বন্যা পরিস্থিতির দেখা দেবে না এ কথা বলাটা সম্পূর্ন ভুল হবে।

যাই হোক,

এখন বলে দেওয়ায় ভালো আজ দুই ব্লকের মধ্যে বেশি জনবসতি এবং সড়কপথের বিস্তার বারাবনি ব্লকের চেয়ে সালান পুর ব্লকে তুলনামূলক বেশি, কারণ রূপনারায়ণ পুরের মত ভারতের বৈদ্যুতিক তার নির্মাণ কারখানা ছিল, এবং চিত্তরঞ্জন রেল শহর, সাথে আছে বিভিন্ন কয়লা খনি অঞ্চল।

তবে অতীতে সালানপুর ও বারাবনী উচ্চভূমি সেরকম বসতি না গড়ে ওঠায় ঘন জঙ্গলে ঢাকা ছিল।আজও চিত্তরঞ্জন এর জমি তে গাছ কাটা নিষিদ্ধ থাকায় প্রচুর বনভূমিতে ভর্তি এবং বারাবনী ব্লকের গৌরাংডি অঞ্চলে প্রচুর বনভূমি এখনও দেখতে পাওয়া যায়, কারণ এখানে মানুষের হস্তক্ষেপ তুলনামূলক কম। সালান পুরের চেয়ে বারাবনী জঙ্গল ছিল সবচেয়ে বড় ও ঘন তাই  এই

“বড় বন” থেকে “বারা বনী” কথাটির জন্ম। অন্য দিকে সালো মানে  “উচুঁ ভূমি বা জমি” থেকে সালান কথাটির জন্ম এরা আজকের দুই উচ্চ ভূমি সালান পুর এবং বারা বনী ।

এখানে আদিম অধিবাসীরা এই উচ্চ ভূমি অঞ্চল থেকে আসানসোল নিম্ন ভূমি অঞ্চল পর্যন্ত অরণ্য সম্পদ এর ওপর জীবিকা নির্বাহ করতো, নিম্নভূমি অঞ্চলটিতে “আসন” নামক এক ধরনের আর্দ্র পর্ণমোচী গাছ প্রচুর দেখা যেত এখন মানুষের হস্তক্ষেপে এই গাছ আর নেই বললেই চলে, সেই “আসন” থেকেই আসান এবং সোল মানে ভূমি,  অর্থাৎ আসন গেছে ভূমি বা আজকের —“আসানসোল”।

এবার এই উচুঁ জমি গুলোতে প্রচুর ঘাস ও গাছ থাকায় বৃষ্টির  জল বেশি বেশি শোষিত হয়ে ভূ গর্ভ চলে গিয়ে ভৌম জলের (ground water recharge) সঞ্চয় ঘটায়।কিন্তু বেশির ভাগ জল ভূপৃষ্ঠে না জমে গড়িয়ে দুই নদ উপত্যকায় নেমে নদী গুলোতে অতিরিক্ত জলের যোগান দেয়। কিন্তু ধীরে ধীরে আসানসোল শিল্পাঞ্চল গড়ে উঠতে উঠতে উন্নত সড়ক পথের বিস্তার, উত্তর রেলপথ ( এই সড়কপথ ও রেলপথ গুলো উচুঁ জলবিভাজিকার শিরা বরাবর প্রসারিত করা হয়েছে এতে বৃষ্টির জল যাতে না জমে)

এবং এর সাথে সাথে ধীরে ধীরে বিক্ষিপ্ত থেকে চারিদিকে গোষ্ঠী বদ্ধ জনবসতি গড়ে উঠতে শুরু করে এই দুই উচ্চ ভূমি বা ব্লক গুলোতে।এর পরিণাম প্রচুর পরিমাণে অরণ্য হারাতে শুরু করে।

সাল ১৯৯০ থেকে ২০০০ , এই সময় ঘর বাড়ি নির্মাণ করার সময় কূপ বা কুয়ো তৈরি করত। সেই সময় ভূ গর্ভের কিছুটা নীচেই (২৫-৩০ ফিট) ভৌম জল পাওয়া যেত। কিন্তু আজ ২০১৭-২০২২ সালের মধ্যে কূপ বা কুয়ো খনন প্রায় আর প্রচলন নেই বললেই চলে ।

বর্তমানে চারিদিকে গভীর নলকূপ খনন করছে ,,২০০-৭০০ এমনকি ১০০০ ফুট গভীর পর্যন্ত নল কূপ খনন করেও অনেক স্থানে ভৌম জল পাওয়া যাচ্ছে না। বলতে গেলে এই অঞ্চলে শুষ্ক ঋতুতে – মার্চ থেকে মে পর্যন্ত ভৌমজল পৃষ্ঠ (ground water table) অনেকটা গভীরে চলে যায়। অনেক অগভীর কুয়ো , পুকুর পুরোপুরি শুকিয়ে খটখটে হয়ে যায়।এদিকে এখন কুয়ো খনন প্রায় নেই এর পরিবর্তে চলছে গভীর নল কূপ খনন।

কারণ

  • ১)এই কূপ খনন করতে বেশি জমির প্রয়োজন , কিন্তু বর্তমানে জমির দাম অনেক বেড়েছে।
  • ২) আগে ভৌম জল পৃষ্ঠ ভূ গর্ভের বেশি গভীরে পতন হতো না, কিন্তু এখন বেশি নীচে পতন ঘটায় কূপ খনন কার্যকরী হবে না। এর জন্য গভীর নল কূপ খনন করা হয়।
  • ৩) কূপ খনন বেশ সময় সাপেক্ষ ও কষ্ট সাধ্য। নল কূপ এক দিন বা দুই দিনের মধ্যেই খনন করা সম্ভব।
  • ৪) বর্তমানে মানুষ দ্রুত কাজ সম্পন্ন করতে ইচ্ছুক এতে বেশি খরচ কে উপেক্ষা করেও নল কূপ খনন করছেন।

 

ভৌমজল দ্রুত পতন ঘটার কারণ

আগেই আমি অঞ্চলের ভূপ্রকৃতি  সম্পর্কে জানলাম। এখন এই অঞ্চলের বনভূমি বৃষ্টির জলকে অনেকটা আঁটকে বাঁচিয়ে রাখতে পারতো এতদিন। মোট বৃষ্টির ঝরে পড়া জল এর ধরি ১০০ ভাগের মধ্যে  ৫০ ভাগ পৃষ্ঠ প্রবাহ রূপে গড়িয়ে নদী বা নালাতে মিশতো এবং বাকি ৫০ ভাগ  শোষিত হয়ে ভূগর্ভে সম্পৃক্ত স্তরে(saturated layer) জমা হতো।কিন্তু ধীরে ধীরে বসতি নির্মাণ করতে অনেক অরণ্য  হারিয়েছে এবং হারাচ্ছে এর ফলে আগের তুলনায় জল কম শোষিত হয় এবং পৃষ্ঠ প্রবাহ মাত্রাও বেড়েছে।

ইতিমধ্যে ২০২০-২২ সালের মধ্যে ,  এই অঞ্চল গুলোতে চারিদিকে আবাসিক এলাকা, বসতি নির্মাণের সাথে সাথে অধিকাংশ জমিতে রাস্তা আর কাঁচা নেই, বরং পিচ বা কংক্রিটের তৈরি সড়কপথ। কারণ অতিরিক্ত বৃষ্টিতে রাস্তায় জল জমে, রাস্তা কাদাময় হয় এই সমস্যা দুর করতে তৈরি করে দিচ্ছে কংক্রিটের রাস্তা।কিন্তু এদিক সামলাতে গেলে অন্য দিকে ভোগ করতেই হবে এটা মাথায় রাখতে হবে।

এর জন্য একদিকে অরণ্য হারিয়েছে এবং আরেকদিকে এই পাকা রাস্তা যা বৃষ্টির ঝরে পড়া জল আর শোষিত হতে দিচ্ছে না,এবং মোট ঝরে পড়া বৃষ্টির জলের ১০০ ভাগের মধ্যে  প্রায় ৯০ গড়াচ্ছে পৃষ্ঠ প্রবাহ রূপে। বাকি ১০ ভাগ কোথাও কাচা জমি থাকলে অল্প পরিমাণে শোষিত হয়। কিন্তু এর পড়েও টনক না নড়লে ১০০ ভাগ জলেই গড়িয়ে যাবে।

দ্বিতীয়ত বহু আবাসিক এলাকা গুলি এবং বসতি অঞ্চল গুলোতে জলের প্রচুর চাহিদা মেটাতে গ্রীষ্ম কালে চারিদিকেই গভীর নল কূপ খনন করে জলকে নিয়মিত তুলে ফেলা হচ্ছে। এতে সমস্যা ওপরে নয়, বরং হচ্ছে ভূগর্ভে, একটা পাইপ নিয়ে দই এর ভাড়ে দুই টানলে দুই এর স্থানটা ইংরিজি v আকৃতির হয়ে পড়ে, ঠিক তেমনি চারিদিক থেকে গভীর নলকূপ থেকে জল তুলে ফেলা মান পাইপ দিয়ে জল তুলে ভূগর্ভে v আকৃতির করে দেওয়া।

এতে জলতল ধীরে ধীরে অনেক গভীরে চলে যায়।

২০২২ সালের মধ্যে সালান পুর ব্লকের ভূ গর্ভের স্থায়ী সম্পৃক্ত স্তরটি অনেকটা গভীরে এই জন্যই চলে গেছে।

এতে নল কূপ খনন অনেক গভীর ভাবে না করলে জল পাওয়া আর যায় না। আবার চারিদিকে ভূগর্ভ বসানো “সাব মার্শল পাম্পে” করে ভৌম জলকে স্ট্র এর মত টেনে তুলে ফেলছে, এতে ভৌম জল আরও দ্রুত পতন ঘটছে। বর্ষা কালে অতিরিক্ত বৃষ্টিতে জল ঘাস জমির মধ্যে শোষিত হলে আবার ভৌম জলপৃষ্ঠ উঠে যায় , কিন্তু শুষ্ক ঋতুতে অতিরিক্ত জল তুলে নেওয়ার ফলে জল পৃষ্ঠ আবার পতন ঘটে।

রূপনারায়ণপুর  অঞ্চলের ওপর একটি বেলে পাথরের স্তরের নীচে আরেকটি কাদা সমৃদ্ধ বেলে পাথর যা অ্যাকুইটার্ড রূপে অবস্থান করে আছে, অর্থাৎ বৃষ্টির জল  এই সব পাথর দিয়ে অতি ধীর গতিতে শোষিত হয়ে ভূগর্ভে  পৌঁছায় , (aqua – জল , tordous – ধীর চলন – ল্যাটিন শব্দ) । এর ফলে রূপনারায়ণপুর অঞ্চলে ভৌমজল  সঞ্চয় অতি ধীর এবং বেশি বেশি জল উত্তোলন করাতে এই অঞ্চলে জল পৃষ্ঠ দ্রুত পতন ঘটে।

গভীর নল কূপ খনন করলেও জল পাওয়া যায় না কেন? অন্য দিকে এর ঠিক কাছেই নল কূপ খননে অল্প গভীরেই জল পাওয়া যায় কেন?

ভূগর্ভে একটি অপ্রবেশ্য পাথরের ওপরে একটি প্রবেশ্য পাথরের সম্পৃক্ত স্তরে  ভূ পৃষ্ঠের জল চুঁইয়ে নীচে এসে জল জমা হয়, এই স্তরকে আমরা বলি “ভৌমজলস্তর বা অ্যাকুইফার”। কুয়োর দিকে তাকালেই আমরা এই অ্যাকুইফার কে দেখতে পাবো।

আগেই বললাম,  এই সালান পুর ও বারাবনী অঞ্চল গুলো উচ্চ ভূমি না এক এক জলবিভাজিকা এতে জল শোষিত হয় কম পৃষ্ঠ প্রবাহ চলে বেশি, অন্য দিকে ভূগর্ভে যে পৃষ্ঠ বা তল বরাবর ভৌমজল স্তর বা অ্যাকুইফার শুরু হয় সেই জল পৃষ্ঠ জলের সমোচ্চশীল ধর্মকে মান্যতা করে না , নদী যেমন জমির ঢাল বেয়ে গড়িয়ে যাচ্ছে নীচু স্থানে কোনো নদী না সাগরের দিকে,

ঠিক তেমনই ভূগর্ভে ভৌমজলও প্রবাহ চলে, এবং এর জল একটি হাইড্রোলিক প্রেসার বা জল চাপ তল সৃষ্টি করে, যা উচ্চ থেকে নিম্ন চাপের দিকে ভৌমজল প্রবাহ চলে এবং কোথাও কোথাও সে প্রস্রবণ এর আকারে ঝর্নার মত বেরিয়েও আসে।

ফলত জমি উচুঁ নীচু থাকলে, বা উচ্চভূমি অঞ্চল গুলোতে ভূগর্ভে ভৌমজল পৃষ্ঠ সামান্য উচুঁ হয়ে নীচু উপত্যকায় জল পৃষ্ঠ সামান্য নীচু হয়ে শেষে কোথাও কোথাও পুকুর বা নদীতে চুঁইয়ে বেরিয়ে মুক্তি পায়।

এক গ্লাস জল দেখলে জল পৃষ্ঠ সমান উচ্চতায় থাকে কিন্তু ভৌমজল পৃষ্ঠ মোটেই সমান উচ্চতা বা গভীরতায় থাকে না,

দ্বিতীয়ত জল চাপ কোন দিক থেকে কোন দিকে, এবং ভৌমজল প্রবাহ হচ্ছে কোন দিকে সে দিকটাও গুরুত্ব পূর্ন একটা ভূমিকা পালন করে, এসব নিয়ন্ত্রক গুলোর জন্য কোনো নল কূপে অল্প গভীরেই জল পাওয়া যায় আবার কোনো নল কূপে অনেক বেশি গভীর খনন করলেও জল পাওয়া যায় না।তাই ভাগ্য , পূজো, নারকেল ফাটানো ইত্যাদি এগুলো শুধু একটা অন্ধ বিশ্বাস হয়ে গেছে।

সালান পুর ব্লক অঞ্চলে গরম কালে প্রচুর নল কূপ খনন করা হয় কিন্তু কিছু কিছু নল কূপ অনেক গভীর খনন করার পরেও জল পায় না, এর কারণ ওপরের কারণ গুলোই দায়ী।

আগামী ভবিষ্যতে কতটা জল সংকটের মুখে পড়বে এই অঞ্চল?

আমরা সবাই অসচেতন!

মানুষের মধ্যে কোনো সচেতনতা নেই, মানুষের লোভ দিন দিন বেড়েই চলেছে, নগরায়নের সাথে সাথে বসতি নির্মাণ, পাকা রাস্তা ঘাট , কংক্রিটের রাস্তা দিয়ে ঘিরে ফেলেছে সবাই,  কেবল সালান পুর ব্লকের চিত্তরঞ্জন অঞ্চল এবং বারাবনীর গৌরাংডি অঞ্চলে অধিকাংশ জমিতে অরণ্য সম্পদ বাঁচিয়েছে। তবে ইতি মধ্যে গৌরাংডি অঞ্চলে অরণ্য ধবংস শুরু হয়েছে, পুড়ে গেছে অনেক গাছ।

প্রশাসনিক কড়া পদক্ষেপের জন্য চিত্তরঞ্জন উচ্চ ভূমির প্রচুর বন আজও বেঁচে আছে, কিন্তু রুপনারায়নপুর শহর থেকে বাকি পুরো ব্লক অঞ্চল প্রায় অরণ্য সম্পদ আর খুব একটা নেই সাথে চারিদিকেই বহুতল বসতির বিস্তারে রাস্তা ঘাটও আজ কংক্রিটের শরীর।

ফলে বৃষ্টির জল যেমন একদিকে শোষিত হচ্ছে না,

অন্য দিকে আজ এই বিপুল জনসংখ্যার চাপে জলের প্রচুর চাহিদা বাড়ছে, ফলত এক বর্গ কিমি জমির ওপর ২০০-৪০০ এরও বেশি নল কূপ খনন করা হচ্ছে যা অগণন। পাম্প বসিয়ে টুকে ফেলা হচ্ছে প্রচুর পরিমাণ ভৌমজল ।

সাথে এই অঞ্চলের ওপর গাছ কাটা এখনও চলছে, এবং মাটি আলগা হয়ে অতিরিক্ত পৃষ্ঠ প্রবাহ দ্বারা বালি পলি নদীতে গিয়ে মিশে নদীর নাব্যতা কমিয়ে , অতিরিক্ত বৃষ্টিতে আসানসোল নিম্নভূমিতে বন্যাকে তরান্বিত করছে।

এভাবে চলতে থাকলে আগামী ২০৫০-৬০ সালের মধ্যে বৃষ্টির জল আর শোষিত হবে না, কারণ কংক্রিটের শরীর ভেদ করে জল চুঁইয়ে নামবে পারবে না, শেষে পুরোটাই পৃষ্ঠ প্রবাহ রূপে জমি ধুয়ে মিশবে কোনো নদীতে, অজয় ও বরাকর জলাধার গুলোতে বর্ষায় জলস্তর বাড়বে এবং তাদের আশেপাশের গ্রাম ও বাস্তুতন্ত্র প্রচুর ক্ষতি করবে, নষ্ট হবে স্থানীয় জীব বৈচিত্র্য।

অন্যদিকে শুষ্ক খটখটে গ্রীষ্মকালে ব্লক উচ্চভূমি অঞ্চলে ভৌমজলতল  এতটা নীচে নেমে যাবে যে স্থায়ী সম্পৃক্ত স্তর থেকেও আর জল পাওয়া যাবে না; প্রত্যেক নল কূপ থেকেও বা পাম্পে জল তোলা সম্ভব হবে না।

এভাবে জলের জন্য চারিদিকে হাহাকার দেখা যাবে।ঘটবে বিরাট “জল সংকট” । এতে স্থানীয় – বাসিন্দারা তখন এখান থেকে বাস্তুহারা হতে বাধ্য হবে, বাস্তুতন্ত্র প্রচুর ক্ষতি হবে,পাখি পশুর ক্ষতি হবে, এমনকি জলের জন্য মানুষে মানুষে সংঘর্ষও ঘটতে দেখা দিতে পারে বলে আমার অনুমান।

আমার কী আদও জল সংকট পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারব

আমরা কী ক্ষরা বন্যার সম্পর্ককে বা সুন্দর প্রণালী বা ভারসাম্য বজায় রাখতে পারবো

প্রথমেই চাই জনসচেতনতা বৃদ্ধি, আজ আমরা প্রকৃতিকে নিজের বশে আনতে চাইছি এবং এর সাথে সাথে প্রকৃতির এই সুন্দর প্রণালী কে নষ্ট করে ফেলছি,  কিন্তু সে তার প্রণালীকে সর্বদা বজায় রাখতে চায়, আর এই ভারসাম্য নষ্ট হলেই এর পরিণাম যে কি হবে তা আমার বলায় বাকি রইল!!!

 

পশ্চিম-বর্ধমান-জেলার-দুই-ব্লক-পড়তে-পারে-সবচেয়ে-বেশি-জল-সংকটের-মুখে2-300x165.jpeg

 

জলবিভাজিকা উন্নয়ন

সমগ্র উচ্চ ভূমি অঞ্চলে স্থানে স্থানে  একটা বিরাট এলাকা জুড়ে অরণ্য ভূমির বিকাশ ঘটাতে হবে।

সামাজিক বনোসৃজনে জোর দিতে হবে যেমন – রাস্তার ধারে ধারে আরও গাছ লাগানো,ফাঁকা জমি গুলো পতিত জমি এবং কৃষির আশেপাশে গাছ লাগাতে হবে। অনেকটা স্থান জুড়ে তৃণ জমি গড়ে তোলা এবং সাথে সাথে পশুচারণ নিয়ন্ত্রণের দিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে। চিত্তরঞ্জন শহরে বসতি গুলিতে গাছ লাগানোর জোর দেওয়া হয়েছে, তেমনই গোটা ব্লক অঞ্চলে প্রশাসনিক ক্ষেত্রে কড়া পদক্ষেপ এখন থেকেই নেওয়া জরুরী, যেমন প্রত্যেক বাড়ির নির্দিষ্ট জমিতে চারা গাছ লাগানো বাধ্যতামূলক।

কংক্রিটের রাস্তাঘাট নিয়ন্ত্রিত ভাবে গড়ে তুলতে হবে পঞ্চায়েত স্তরে।

প্রচুর বৃক্ষরোপণ একদিকে বৃষ্টির জলের পৃষ্ঠ প্রবাহ কমায়, তেমনই অতিরিক্ত জল ভূগর্ভে শোষিত হয়ে ভৌমজলের পুনঃসঞ্চয় (ground water reacherge) ঘটায়।

দ্বিতীয়ত গাছ এক দিকে মাটি ক্ষয় আঁটকে অতিরিক্ত বালি ,মাটি নদী খাতে না পড়ে , নদীর নাব্যতা বজায় রেখে নিম্নভূমি অঞ্চল গুলোতে বন্যা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে।

এর সাথে নদী গুলোর অতিরিক্ত পলি তুলে দেওয়ার ব্যাপারেও স্থানীয় প্রশাসনকে নজর দিতে হবে।

বৃষ্টির জল ছাদে থেকে কুয়োর সঞ্চয়

বিভিন্ন স্থানে কংক্রিটের রাস্তাঘাট এবং দেখা যায় বৃষ্টির অতিরিক্ত জল ছাদ হয়ে নীচের জমিতে পড়ে রাস্তা বা বড় ড্রেন হয়ে গড়িয়ে কোনো নদীতে মিশে যায়,  এভাবে অতিরিক্ত জল নদীর জলস্তরকে বৃদ্ধি করে ফেলে।

কীভাবে করা যাবে এই জল সংরক্ষণ?

ছাদের ওপর ঝরে পড়া বৃষ্টির জল পাইপ দিয়ে নেমে আসে,  এখন কংক্রিটের মেঝে থাকলেও আমরা  প্রত্যেকে কুয়োর মধ্যে যদি এই ছাদের জলকে ফেলতে পারি তবে এই কুয়োর মাধ্যমে অতিরিক্ত জল শোষিত হবে, এবং শুষ্ক সময়ে  ভৌম জলের কিছুটা ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব হবে। এতে আমরা জল সম্পদ কে অনেকটাই বাঁচিয়ে ভবিষ্যতে চরম জল সংকট থেকে কিছুটা হলেও রেহাই পাবো।

স্থানে স্থানে নল কূপ খনন করা নিষিদ্ধ

বসতি বাড়ছে এবং এর সাথে জনসংখ্যাও বাড়ছে এতে জলের চাহিদা বেড়েই চলেছে ফলত এখন স্থানে স্থানে প্রতিটা বাড়িতে নল কূপ খনন করা হচ্ছে; কিন্তু সরকার এভাবে বাড়িতে  বাড়িতে নিক কূপ খনন করা বন্ধ করে নির্দিষ্ট স্থানেই পরিকল্পনা মাফিক একটা করে নল কূপ খনন করে, তবে অতিরিক্ত ভৌম জল উত্তোলন থেকে একটা নিয়ন্ত্রিত অবস্থায় আসবে। কারণ বিভিন্ন স্থানের নল কূপ থেকে জল তুললে জলতল অনেক নেমে যায়।

মাইথন জলাধার থেকে পানীয় জলের সরবরাহ

মাইথন জলাধারে প্রচুর পরিমাণে জল ধারণ করতে সক্ষম, ঝাড়খন্ড এবং পশ্চিমবঙ্গের উচ্চ ভূমি অঞ্চলে জল গড়িয়ে যাচ্ছে এই জলাধারে, ফলত দিনে দুইবার করে নির্দিষ্ট সময় মত পানীয় জলের সরবরাহ করা উচিত।

এছাড়াও বহু স্থানে দেখতে পাওয়া যায়, পানীয় জলের কল গুলো খুলে চলে যাওয়া হয়, পানীয় জলে স্থান করার সময় অনেক জল অপচয় হয়। পানীয় জলের অপচয় রোধ করার জন্য প্রশাসনিক কড়া পদক্ষেপ নিতে হবে, এবং এটা বাধ্যতামূলক করা জরুরী।

 

পশ্চিম-বর্ধমান-জেলার-দুই-ব্লক-পড়তে-পারে-সবচেয়ে-বেশি-জল-সংকটের-মুখে-3-300x141.jpeg

উপসংহার

 

পরিশেষে বলা যায়, আমাদের এই সুন্দর প্রাকৃতিক প্রণালী, এবং যাদের সাথে প্রতি নিয়ত অন্ত সম্পর্কের মাধ্যমে আমরা টিকে আছি, সেই সুন্দর প্রণালীর ভারসাম্যটিকে আমাদের বজায় রাখতে হবে। অর্থাৎ আমরা আমাদের এই ব্লক অঞ্চল গুলোতে উক্ত উপায় গুলোর দ্বারা যেমন আগামী ভবিষ্যতে চরম জল সংকট থেকে কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণ করতে পারি, সাথে সাথে অতিরিক্ত জল ও নদীর নাব্যতা হারিয়ে নিম্ন ভূমি অঞ্চলে (আসানসোলের বন্যা সমস্যা) বন্যা থেকেও আমরা বাঁচাতে পারি। হ্যাঁ আমরা সবাই সচেতন হবো, আমাদের পরিবেশকে, আমাদের স্থানীয় জীব বৈচিত্র্য, বাস্তুতন্ত্র, জল সম্পদ কে রক্ষা করতে হবে।

কারণ এই খরা ও বন্যা একে অন্যের সাথে পুরোপুরি সম্পর্কিত।

Leave a Comment