বন্ধুদের লেখা

আমার কম্পোস্ট, রান্নাঘরের জঞ্জাল মুক্তি

আমার কম্পোস্ট, রান্নাঘরের জঞ্জাল মুক্তি

কলমেঃ অনুপম মজুমদার

লেখক পরিচিতিঃ

অনুপম মজুমদারঅনুপম বাবু ছাদ বাগান এবং কম্পোস্টিং বিশেষজ্ঞ।

 

—————————————————————————————————————

এই পদ্ধতি জাপানের এক অধ্যাপকের আবিষ্কার। নাম বোকাশি কম্পোস্টিং। আমি প্রথমে দুটি ১০ লিটারের কম্পোস্ট বিন কিনেছিলাম সম্ভবত ১২০০/১৩০০ টাকায়। তার সংগে ওরা একটা গ্লাভস, ৫০০ গ্রাম বোকাশি ব্রান মাইক্রোব দিয়েছিল। প্রথমে বিনের নীচে একটা কাগজ পেতে তার উপরে একটু গুড়ের গুঁড়ো আর এক চামচ ব্রান ছড়িয়ে শুরু। তার উপরে প্লাস্টিক, দুধ বা তরল বাদে সব রকমের রান্ন না করা বা করা জিনিস দেয়া যাবে। সব রকমের সবজির খোসা, ডিমের খোলা, চায়ের পাতা, ফলের খোসা মাছের কাঁটা, মাংসের হাড় ইত্যাদি সব কিছু। এক একটা লেয়ার এক ইঞ্চি করে হবে, তার উপরে এক চামচ করে বোকাসি মাইক্রোব ছড়াতে হবে।প্রতিদিন ফেলুন আর একটা থালা বা লিড দিয়ে চেপে সমস্ত হাওয়া বার করে বিনের ঢাকনা দিয়ে মুখ বন্ধ করে দিন। এই ভাবে বিন ভরে গেল, রেখে দিন।

সাধারান ভাবে গরম কালে ২০ দিন আর শীত কালে ২৫ দিন পরে বিনের মুখ খুলে দেখুন উপরে সাদা মোল্ড হয়ে গেছে। যদি কোন গন্ধ বেরোয় তবে সেটা ভিনিগারের মতন গন্ধ হবে। এর মাঝ প্রতি দুই তিন দিন অন্তর নীচের যে কল আছে সেটা খুলে বিন টাকে একটু টিল্ট করলে দেখবেন খানিকটা করে তরল বেরিয়ে আসবে। ওটা খুব এসিডিক, পি এইচ ৫/ ৫.৫. ওর সংগে ১;৩০ রেশিও জল মিশিয়ে, জল বেশিও মেশাতে পারেন, গাছের গোড়ায় দিন। ওটাও ভালো তরল সার। এই বিন থেকে কিন্তু কোন গন্ধ বেরুনোর কথা নয়। যদি বেরোয় বুঝতে হবে বিনের মুখ বন্ধ হয়নি। (বোকাশি ব্রান বস্তুটি আসলে ল্যক্টো ব্যসিলাস। বড়ীতে তৈরি করা যায়। পরে লিখব কি ভাবে। আমি যদিও কিনি। কারন আর কিছুই নয়, আমার বয়স। পেরে উঠি না।) এই পর্যন্ত পুরো পুরি বোকাশি পদ্ধতি।পরের স্টেজে আদর্শ বোকাশি পদ্ধতি হল ঐ ফারমেন্টেড বস্তুগুলি মাটির নীচে পুঁতে দেয়া। কিন্তু আমার বাড়ীতে সেটা সম্ভব নয়। তাই আমি একটু অন্য পদ্ধতিতে করি।

একটা বড় টবের (১৮ ইঞ্চ) বা টবের বদলে বড় মাপের শক্ত বালতি হলেও চলবে, নীচটা তিন/ চার ইঞ্চি মাটি দিয়ে তার উপরে এক ইঞ্চি কোকোপিট ছড়িয়ে দেয়া। তার উপরে দুই ইঞ্চি করে ফারমেন্টেড জিনিস দিয়ে তার উপরে আবার দুই ইঞ্চি করে কোকোপিট ছড়ানো। ঐ কোকোপিটের উপরে এক চামচ করে এরোবিক কম্পোস্টার ছড়িয়ে দিলে ভালো। এই ভাবে টবটার মধ্যে গোটা বিনটিকে খালি করে উপরে ভালো করে কোকোপিট ও কম্পোস্টার ছড়িয়ে টবের মুখটা এমন কিছু দিয়ে ঢাকা দেয়া যাতে হাওয়া ঢুকতে পারে কিন্তু মাছি বা পোকা মাকড় না ঢোকে। আমি পুরনো ফেলে দেয়া মাশারি কেটে সেটা উপরে দিয়ে চার পাশ দড়ি দিয়ে বেঁধে দেই। তার পরে সাতদিন অন্তর একটু করে ঘেঁটে দেয়া।যদি দেখেন ময়সচার নেই তাহলে একটু জল স্প্রে করে দেয়া। এই ভাবে ১৫ দিনে থেকে ২০ দিনের মধ্যে কম্পোস্ট তৈরি। এবারে মোটা বালি চালা চালুনি নিয়ে চেলে একেবারে গুড়ো হয়ে যাওয়া কম্পোস্ট প্যাকেটে ভরে রাখা। আর যে গুলো এখনো পুরো ব্রেক করেনি সেগুলো আলাদা করা। পরের রাঊন্ডে সেগুলোই ফারমেণ্টেড বস্তু গুলোর উপরে ছড়িয়ে লেয়ার করা। তখন আর এরোবিক কম্পোস্টার ছড়ানোর দরকার নেই। ঐ আগের আধা কম্পোস্ট গুলোর মধ্যেই প্রচুর এরোবিক মাইক্রোব রয়ে গেছে। তারাই ব্রেক ডাউন করার কজটা করবে।

এবারে এই কম্পোস্টের নিউট্রিশান ভ্যালু কতটা। এটা নির্ভর করবে আপনি বিনে কি দিয়েছেন তার উপরে। সবুজ সব্জির খোসা ঘাস ইত্যাদি দেবে নাইট্রোজেন, কলার খোসা প্রচুর পটাশিয়াম দেবে, ডিমের খোলা হাতে গুঁড়ো করে দেবেন তাতে প্রচুর ক্যালসিয়েম ইত্যাদি। আমার বিনে ফসফেট কম থাকে বলে দু একটা লেয়ারে আমি একমুঠো করে স্টিমড বোন মিল দেই। ফলে আমার কম্পোস্ট মোটামুটি কমপ্লিট  কম্পোস্ট হয়। তাতে সতেজ গাছ হয়।
আমার মাটির রং কালো।

বোকাশি কম্পোস্ট

কেন বোকাশি?

পঁচিশ বছর হয়ে গেল আমি রান্না ঘরের জঞ্জালের সদ্ব্যবহারের ইচ্ছে নিয়ে কম্পোস্ট করার চেষ্টা করছি। ট্রাডিশানাল কম্পোস্ট করার পক্ষে আমার বাড়ীটা মোটেই উপযুক্ত নয় বলে একটা বড় জলের ট্যাংক (প্লাস্টিকের) কিনেছিলাম। তাতে কাগজ এবং রান্নাঘরের বর্জ ফেলে, কার্বোন নাইট্রোজেন রেসিও ঠিক রাখার চেষ্টা দিয়ে বছর দশেক নানা ধরনের পরীক্ষা করে দেখলাম চারটে প্রধান সমস্যা হচ্ছে।

এক, খোলা ছাদে বর্ষা কালে জল ঢুকে সমস্যা হচ্ছে।

দুই, ভিতরে কিছু অবাঞ্ছিত পোকা এসে হাজির হচ্ছে। তিন, কম্পোস্ট রেডি হতে বড্ড সময় লাগে, আমি ছয় মাসের নীচে করতে পারিনি। চার, গন্ধ হয়। কম্পোস্টে কোন মিথেন গ্যাস না বেরুলেও বাড়ীর লোক ছাদে যেতে পছন্দ করত না। এবং একটু দূষন ত হতই। ব্যাপারটা আমার কাছে যতটা সমস্যাদায়ক ও শ্রমসাধ্য ততটা ফলদায়ি মনে হচ্ছিল না। বন্ধ করে দিলাম। গেছো গৌরকে ( যে মাঝে মাঝে আমার ছাদ পরিস্কার করতে আসে এবং গাছের কাজ করে বলে জানতে আসে কিছু সমস্যা হলে) ওই জলের ট্যাংক দিয়ে দিলাম। খুশি হয়ে নিয়ে গেল। কি করেছে সেটা দিয়ে জানিনা। তার পরে বেশ অনেক বছর কেনা ভার্মিকম্পোস্ট ইত্যাদি দিয়ে চালালাম। দূঃখের সঙ্গে হলেও বাড়ীর বর্জ ফেলে দিতে হচ্ছিল। হঠাৎ ইন্টারনেটে নজরে এল বোকাশি। ( ইন্টারনেটে বোকাশি নিয়ে অনেক youtube টিউটোরিয়াল আছে।আগ্রহীরা দেখে নিতে পারেন) শুরু করে দিলাম। দেখলাম ট্রাডিশানাল কম্পোস্টের তুলনায় পরিশ্রম নেই বললে চলে।

সুবিধে অনেক।

এক, কার্বোন নাইট্রোজেন রেসিও নিয়ে ভাবতে হয় না, অথচ দারুন কম্পোস্ট হয়।

দুই, খুব সহজ, প্রায় বিনা পরিশ্রমে।

তিন, এত তাড়াতাড়ি কম্পোস্ট আর কোন ভাবে হয় না।

চার, রান্নাঘরের সব অর্গানিক বর্জ এতে দেয়া যায়।

পাঁচ, কোন দুর্গন্ধ নেই। দূষনও নেই।

ছয়, কোন অবাঞ্চিত পোকামাকড়ের জ্বালাতন নেই।

সাত, ছোট বাড়ী বা ফ্লাটের ক্ষেত্রে আদর্শ।

আগে বলেছি বোকাশির দ্বিতীয় ধাপ নিয়ে সমস্যার কি সমাধান করেছি। বোকাশি কম্পোস্টের দুটি আন্তর্জাতিক গ্রুপে আছি আমি ।সেখানের অনেকে এখন আমার কাছ থেকে এই পদ্ধতিটা নিয়ে খুব খুশি। প্রসংগে বলি, যাঁদের খুব ছোট ফ্লাট, বড় টব বা বালতি রাখার সুবিধে নেই তাঁরা এই সেকেন্ড স্টেজের জন্যও বিন কিনতে পারেন। সেটাতেও খুব ভালো কাজ হয়। আমার যেটুকু খরচ হয় সেটা পুষিয়ে যায়, কারন আমায় আর গাছের জন্যে কম্পোস্ট বা অন্য কোন ম্যানিওর কিনতে হয় না। শুধু একটু সরষের খোল বছরে কেজি তিনেক, কিনলেই হয়।

এই বোকাশি কম্পোস্টের উদ্দেশ্য আমার কাছে আবর্জনার সদ্ব্যবহার। তার সাথে গাছ করা। দুটোই পরিবেশের স্বার্থে। গত ২৬ শে ডিসেম্বরে বোকাশির প্রথম কিস্তিতে মুনমুন কির্তনীয়া, স্বাতী চন্দ্র ও মদন দাস মতামত দিয়েছিলেন,তাঁরা যে ভাবে এই জঞ্জাল মুক্তির জন্য কম্পোস্ট করছেন সেই বিষয়ে। ওনাদের পাদ্ধতিগুলিও ভালো। যাঁর বাসস্থানের পক্ষে যেটা সুবিধাজনক তিনি সেই পদ্ধতি নিতে পারেন। পরিবেশ বিষয়ক নিয়ামক সংস্থা সমস্ত অর্গানিক বর্জ দিয়ে সার তৈরি করতে বলেছে।এটা আমরা মানব না কেন এবং বাড়ীতে সাধ্য ও জায়গা অনুযায়ী গাছ লাগাবো না কেন? যদিও পৌরসভা ও পঞ্চায়েত গুলি পরিবেশ সংক্রান্ত নিয়ামক সংস্থার এই কথা মানছে না। কিন্তু “তুমি অধম তা বলিয়া আমি উত্তম না হইব কেন?” বঙ্কিম চন্দ্রের এই কথাটা আমার খুব পছন্দ।

আরো পড়ুন

টবে সবজি করা। জৈব সারের ব্যবহার

Leave a Comment