বন্ধুদের লেখা

খাবার ও বাজার 

খাবার ও বাজার

কলমেঃ অংশুমান দাস

লেখক পরিচিতিঃ

অংশুমান দাসঅংশুমান দাশ দু দশকেরও বেশি সময় ধরে খাদ‍্য সুরক্ষা ও চাষবাস নিয়ে দেশে বিদেশে কাজ করছেন। এখন Welthungerhilfe র সঙ্গে যুক্ত ও কলকাতা বিশ্ববিদ‍্যালয়ে Agroecology র কোর্স করান। যোগাযোগ dasanshuman@yahoo.com

 —————————————————————————————————————

কৃষিপণ্যের বাজার নিয়ে দেশ জুড়ে হাওয়া গরম। একদিকে কৃষকদের চিন্তা ন্যূনতম সহায়ক মূল্য থাকবে কি থাকবে না তা নিয়ে, অন্যদিকে সাধারণ উপভোক্তার চিন্তা সরকার কি আর ফসল কিনবেন, কিনে সরবরাহ করবেন রেশনে, মিড ডে মিলে বা অঙ্গনওয়ারিতে? মজুতদারির সীমা লোপাট করে দিলে খাবারের দাম কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে – এই চিন্তায় কপালে ভাঁজ। আর চুক্তি চাষে খাবারের বৈচিত্র, কী চাষ করব, কী খাব সেই সিধান্তের অধিকারও জলাঞ্জলী – সে সবও এক চিন্তার বিষয় বটে। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি ভালো নয়।

তা আমাদের খাবার দাবারের বাজার ব্যবস্থা চলে কি ভাবে? উৎপাদক ফলাচ্ছেন, মাঝখানে একদল লোক কৃষকের বাড়ি বাড়ি ঘুরে, সব মালপত্র একজায়গায় জড় করে, বাজারে নিয়ে যাচ্ছেন। কখনও কখনও কৃষক মাল বাজারে নিয়ে যান নিজেই। তারপর সেই মাল বেসাতি হয় পাইকারি বাজারে, নয় যায় সরকার পরিচালিত মান্ডিতে বা খুচরো বিক্রি হয়। মান্ডি থেকে কিনে সরকার গুদামজাত করে রাখেন সরকারি প্রকল্পে দেওয়ার জন্য বা ভবিষ্যৎ খাদ্য নিরাপত্তার খাতিরে মজুত রাখেন। বাঃ, সব যদি এমনি সুন্দর সিস্টেম করা আছে তাহলে গণ্ডগোলটা কোথায়? আছে গন্ডগোল আছে। প্রথম ফাঁড়া উৎপাদনেই। প্রকৃতি বান্ধব দেশজ পদ্ধতির উন্নতির কথা না ভেবে, হাইব্রিড বীজ-রাসায়নিক সার-মাটির তলার জল নির্ভর চাষ ব্যাবস্থা আমদানী করে জল মাটি মানুষের স্বাস্থ্য বেহাল। এ কথা ধীরে ধীরে বুঝেছেন মানুষ – তাই সাধারণ ভাবে রাসায়নিক নির্ভর চিরাচরিত চলতি বাজার (এখানে অবশ্য জৈব, রাসায়নিক, অকৃষিজাত খাবার সবই একসাথে আসে)-এর পাশাপাশি জৈব খাবারের বাজার তৈরি হচ্ছে, মানুষজন ধীরে ধীরে সচেতন হচ্ছেন। এখানেও একটা মস্ত গন্ডগোল পেকে আছে। কারণ এতে লাভ আছে তা বুঝতে পেরে অসাধু ব্যবসায়ীর মুনাফা লোটার ফিকির যেমন রয়েছে, তেমনই পাশাপাশি ছোট উদ্যোগের রয়েছে অপরিকল্পিত অনিয়ন্ত্রিত অপেশাদার ব্যাবস্থার থেকে বাইরে বেরিয়ে আসার অনীহা। ফলে কেউ করছেন মুনাফা, কেউ আবেগের বশে নিজের পকেট থেকে ভর্তুকি দিয়ে জৈব খাবারের ব্যবসা চালাচ্ছেন – আদতে ক্ষতি বিকল্প খাবার বিকল্প ব্যবস্থা – এই ধারণাটার। এই বদ্ধ কুয়োয় আটকে তা আর সাবালক হয়ে উঠছে না।

প্রসঙ্গত, ২০২০-২১এ খাদ্য রপ্তানী বেড়েছে ১৭.৩৪ শতাংশ, ভারত প্রথম ১৫ টা কৃষিপণ্য রপ্তানী করা দেশের মধ্যে এখন – ৪১.২৫ বিলিয়ন ডলার তার বাজার। জৈব বাজার ২০২৫ এ নাকি ৭৫০০০ কোটি টাকায় দাঁড়াবে। তাতে অবশ্য কৃষকের লবডঙ্কা। ২০১২র তুলনায় ২০১৭তে রোজগার বেড়েছে মাসে ২০০০ টাকা – ইনফ্লেশন ধরলে – আসলে কোন রোজগারই বাড়েনি। যাদের জমি ১ একরের মধ্যে – তাদের মাসিক রোজগার ৪০০০ টাকা। দেশের ৮৭% কৃষকের জমি ৫ একরের মধ্যে – তাদের মাসিক রোজগার ৫২০০ টাকা। ২০১৫ থেকে ২০১৯ মার্চ মাসের মধ্যে ২৯৬৪৩৮ জন কৃষক আত্মহত্যা করেছেন। উৎপাদন আর রপ্তানীর ঠমক চমকে লাভ কী?

খাবার ও বাজার

————————————————————————————————————

হিসাব নিকাশ

খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান জমি থেকেই আসতে হবে। আর জমির জন্য মারপিট লেগেই আছে – সে কথাও নতুন নয়। একটা জটিল অংক বুঝে নেওয়া যাক। পৃথিবীর ৩১ শতাংশ জমি চাষযোগ্য – ১১ (১৫০ কোটি হেক্টর) শতাংশ জমিতে এখন চাষ হয়। হিসেব মত ৪০ লক্ষ হেক্টর মত জমি প্রতি বছর নতুন করে চাষের আওতায় আনতে হবে বেড়ে ওঠা জনসংখ্যাকে মাথায় রেখে। বায়োফুয়েল, নগরায়ন, কলকারখানার জন্য কাঠ/কাগজ, উর্বরতা নষ্ট হয়ে যাওয়া সব ধরলে প্রতি বছর ১ কোটি ৬০ লক্ষ হেক্টর নতুন জমির দরকার। এই হিসেবে চললে ২০৫০-এর মধ্যে আমাদের চাষযোগ্য জমি শেষ। এখনও পর্যন্ত এই জমির বলিদানের পরিবর্তে কোনমতে আজে বাজে একঘেঁয়ে খাবার উৎপাদন করে পৃথিবীর চলছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। অধিকাংশ জমি হয় ধান, নয় গম, নয় ভুট্টার কবলে। ৮৫ লক্ষ মানুষের খাবারের সুরক্ষা নেই, ২০০ কোটি মানুষ সঠিক খাবারের অভাবে ভুগছেন আবার প্রায় সমপরিমাণ মানুষ প্রয়োজনের তুলনায় মোটাসোটা।  পাশাপাশি ২০১৩ র হিসেবে গড়ে মাথাপিছু ২৪০০ ক্যালরি খাবার উৎপাদন হয় ভারতে – আর বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে ভারতের  জায়গা ১১৫ দেশের মধ্যে ১০২। কতই রঙ্গ দেখি দুনিয়ায় – তাহলে উৎপাদন কম হচ্ছে এরকমটা নয়, বরং পৃথিবী জুড়ে প্রয়োজনের দ্বিগুণ হচ্ছে – এটাই বলছেন বিজ্ঞানীরা। সুতরাং জমির যে চাহিদার কথা উপরে বললাম – সেটা পুনর্বিবেচনার জায়গা রয়েছে।

একটা গোদা হিসাবে একটা পঞ্চায়েত বা ব্লকের মোট জমিকে মোট জনসংখ্যা দিয়ে ভাগ করে চাহিদা অনুযায়ী ফসল উৎপাদন ও বণ্টন করলে কেমন হয়? এই হিসাবটা কষার চেষ্টা করে দেখা যাক। ২০১৮-১৯-এ ১১৬.৪৮ মিলিয়ন টন চাল আর ১০৩.৬ মিলিয়ন টন গম উৎপাদন হয়েছে। সরকারি হিসাবে আরও এটা সেটা ধরে ২৮৫.৯৫ মিলিয়ন টন খাদ্য শস্য উৎপাদন হয়েছে। এই সংখ্যাটাকে সোজাসুজি ১৩০ কোটি জনসংখ্যা দিয়ে ভাগ করলে দাঁড়াচ্ছে দিনপ্রতি মাথাপিছু ৫৫০গ্রাম করে খাদ্যশস্য। এই হিসাবটা অতি অতি সরলীকৃত, অনেক কিছু ধরা হয়নি। যেমন ধরা হয়নি, সরকারি গোডাউনে ১৮০০০০০০ কেজি (২০১৪-১৫)  খাবার নষ্ট হয় প্রতি বছর। যেমন ধরা হয়নি প্রতি বছর একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ খাবার তুলে রাখতে হয় স্টক হিসাবে। তেমনি এটাও ধরা হয়নি আমাদের দেশের মানুষ কেবল এক দু ধরণের খাদ্য শস্য খেয়েই বেঁচে থাকেন না – ধান আর গমই একমাত্র খাদ্য বলে আমাদের গিলিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এই হিসাবটা একটা সূত্র নিশ্চয় দিচ্ছে যে – এখন যা উৎপাদন করছি, তা সঠিকভাবে পরিকল্পনা করলে স্থানীয়ভাবে লোকজনকে খাইয়ে পরিয়ে রাখা যায়। গোডাউনগুলিকেও যদি আরও স্থানীয় করে ফেলা হয়, কেনা বেচা সবটাই? তাহলে এর সঙ্গে জুড়ে যেতে পারে স্থানীয় খাবারকে অগ্রাধিকার দেওয়ার বিষয়টিও। এই যে বাজার বলে দিচ্ছে কোনটা আমার খাবার, কোনটা আমার ফসল – এই শিকল থেকেও বেরিয়ে আসা যাবে। বেরিয়ে আসা যাবে পৃথিবীব্যাপী ধান, গম, ভুট্টা চাষের দাসত্ব থেকে। হ্যাঁ – ধান গমের উৎপাদন কমবে, কিন্তু আরও অনেক স্থানীয় ফসল তার জায়গা নিতে পারে।

খাবার ও বাজার

————————————————————————————————————

খাবারের বাজার, বাজারের খাবার

বাজার বললেই জিভ কাটেন নাকি? বাজার ও মুনাফা শব্দ দুটিতে বিস্তর আপত্তি? – আমারও ছিল। এখনও আছে – কিন্তু বাজার ও মুনাফার ধরণে, ঐ শব্দ দুটিতে নয়। শ্রমবিভাজন যেহেতু মেনে নিয়েছি তাই জিনিস আদান প্রদানের জন্য বাজার ও তাতে সংশ্লিষ্ট মানুষের রোজগারের বিষয়টি আর অস্বীকারের উপায় নেই। বাজারের সঙ্গে চাহিদা বিষয়টারও একটা ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আছে – এবং চাহিদার সঙ্গে ভোগবাদের – ইংরেজীতে যাকে বলে কনজিউমারিজম। সমাজে আমার অবস্থানও এই ভোগ, অর্থাৎ আমি কী কিনছি, আমার যা  ‘ইচ্ছা’ তাই আমি কিনতে পারছি কিনা – এর ভিত্তিতেই তৈরি হয়। আর এই যে ইচ্ছা – এইটা শুধুমাত্র আমার ব্যাক্তিগত চাহিদার থেকে আসে না, এটা নব্য-অর্থনৈতিক জমানার দান – যা সরকারি মদতে তৈরি করে বহুজাতিক সংস্থা। আমরা এর দাস মাত্র। আমাদের নিজেদের বুদ্ধিশুদ্ধি লোপ পেয়েছে – তাই বিজ্ঞাপনের বুদ্ধি ধার করেই চলছে আমাদের। জৈব বাজারও এখন এই ভোগবাদী মানসিকতারই ফসল। শপিংমলে, বড় দোকানে, এন জি ও অথবা ব্যাক্তিগত উদ্যোগে চালানো ছোট দোকানেও আজকাল কিছু মানুষ জৈব খাবার কিনছেন বটে। এবং এর সংখ্যাটা বাড়ছে – একটা কারণ সচেতনতা, অন্য একটা কারণ বিজ্ঞাপন, সার্টিফিকেশন, ফ্যাশান। এখানে আলোচ্য সমালোচনাগুলি কী কী?

রাসায়ানিক সার বিষের বদলে গোবর দিয়ে চাষ করলেই জৈব চাষ হল এটা একটি আদিম ধারণা। মাটির তলা থেকে জল তুলে চাষ, বাজার থেকে আনা গোবর-কম্পোস্ট-ভার্মিকম্পোস্ট দিয়ে চাষ, অন্য কোথাও থেকে আনা মাটি, অপুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি দিয়ে চালানো ট্রাক্টর বা যন্ত্রপাতি, বাজার থেকে আনা হাইব্রিড বীজ – এগুলির একটাও ‘জৈব’ চাষের আওতায় পড়ার কথা নয়। একরের পর একর এক ধরণের ফসলের কোম্পানি পরিচালিত জৈব চুক্তি চাষও ‘জৈব’ চাষ নয়। ভার্মিকম্পোস্ট দিয়ে করা বাজার চলতি লাল বাঁধাকপি ব্রকোলি এইসব ফ্যাশন ফসল চাষও ‘জৈব’ চাষ নয়। প্রচুর তেল পুড়িয়ে গাড়ি চেপে বিশাল দূরত্ব থেকে আসা জৈব পণ্যও ‘জৈব’ নয়। আমরা কি কেনার আগে এগুলো জিজ্ঞেস করছি? ‘জৈব’ সার্টিফিকেট কি এগুলো দেখে? তাই আজকাল ‘জৈব’র বদলে পরিবেশবান্ধব চাষ শব্দটা ব্যাবহার করতেই বেশি স্বচ্ছন্দ লাগে। ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকরা এখনও পরিবেশ বান্ধব চাষ করছেন – কিন্তু সরকারের প্রচণ্ড চাপ এবং বীজ/সার কোম্পানির জটিল মার্কেটিংএ  তারা ধীরে ধীরে রাসায়নিক চাষে রূপান্তরিত হচ্ছে। তার উপর এখন আসছে চুক্তি চাষের ভ্রুকুটি। আমরা কি তা নিয়েও চিন্তিত, নাকি নিউজিল্যান্ড থেকে আসা জৈব আপেল নিয়ে আমরা খুশি? বা একটা অর্গানিক স্ট্যাম্প লাগানো মশলা কিনেই খুশি, যার দাম অসম্ভব বেশি কারণ ঐ স্ট্যাম্পের খরচও আমাকে বইতে হচ্ছে? অথচ আমার বাজারে হাঁসের ডিম বিক্রি করা বুড়ি মাসি আমার নজর এড়িয়ে যাচ্ছে। প্রিজারভেটিভ দেওয়া টেট্রা প্যাকের খাবার যতই সুস্বাদু, দীর্ঘস্থায়ী আর জৈব হোক না, এটা কি সত্যিই ‘জৈব’? এত কে ভাবছে? আর কেই বা ভাবাচ্ছে?

শপিং মল, কোম্পানি না হয় মুনাফা করতে এসেছে – কিন্তু যারা ছোট, যারা মনে করছেন পরিবেশবন্ধু চাষ ও খাবার একধরণের আন্দোলন তারা কি এগুলি ভাবছেন? তারা কি তাদের উৎপাদকদের সঠিক দাম দিচ্ছেন? এই অস্বচ্ছ বাজার ব্যাবস্থায় তারা, অন্তত, কি তাদের লাভক্ষতির খতিয়ান সকলের কাছে তুলে ধরবেন? তারা কি কৃষক ও ক্রেতা সরাসরি দাম দস্তুর নিয়ে কথা বলবেন – এটা চাইবেন (লাগাম ছাড়া বেনিয়ম মুনাফা হলে কী তার বাধো বাধো ঠেকবে)? নাকি বলবেন – এ আমাদের বিজনেস সিক্রেট? কিন্তু কেউ যদি সৎ ব্যাবসা করেন তাহলে তাঁর নির্দিষ্ট মুনাফা রাখতে তো অসুবিধা নেই! তারা কি প্লাস্টিকের বদলে অন্য প্যাকেজিং-এ যাবেন? তারা কি কাঁচের বোতল ফেরত নিয়ে আবার পরিষ্কার করে তাকে আবার ব্যবহার করবেন? নাকি বলবেন – এর জন্য যা খরচ হবে তা কি দেবেন ক্রেতারা? এ বিষয়ে যথেষ্ট চেষ্টা করা হয়েছে কি? আচ্ছা এই রকম একটা বোতল পরিষ্কার করার ছোট কারখানাই যদি খোলা হয় – আমরা সবাই তার খদ্দের হব কি?

বাজার স্থানীয় হলে, ছোট হলে এসবই করা সম্ভব। দু মুঠো ভাত জোগাড়ই যখন আমাদের চালিকা শক্তি তাহলে খাবার নিয়ে আর একটু ভাবা যাক। চিন্তার দৈন্যতা বড় চিন্তার বিষয়।

খাবার ও বাজার

————————————————————————————————————

কী বেচবেন, কেন বেচবেন

ভারতের নানা রাজ্যে খাবার নিয়ে সচেতনতা বেশ বেড়েছে। মেগা শহরগুলিতে, যেমন ধরা যাক দিল্লীতে, জৈব খাবারের ব্যবসার পাখির চোখ অবশ্য উচ্চবিত্ত। সেখানে জৈব বলতে সার্টিফিকেট ও মার্কামারা পণ্যই বোঝে সবাই – এমনকি কৃষিবাজার বা ফারমার’স মার্কেটেও দাম ধরা ছোঁয়ার বাইরে। প্রচুর শখের কৃষক শহরের আশপাশে খামারবাড়ি করে জাঁকিয়ে বসেছেন – এবং পসরা নিয়ে হাজির হচ্ছেন  ফারমার’স মার্কেটে। অথচ চেন্নাই, পুনে, ব্যাঙ্গালোর শহরে ঝিনচ্যাক অথচ মেঠো (মানে EARTHY বললে আসল গন্ধটা পাওয়া যায়) দোকানের সঙ্গে সঙ্গে সাধারণ মুদির দোকানের পাশে, ক্লাবের মাঠে, কমিউনিটি হলেও বাজার বসতে শুরু করেছে। কৃষকরা আসছেন না, কিন্তু অনেক ছোট ব্যাবসায়ী, অনেক এনজিও জৈব খাবারের বড়লোকি শিকল খুলে দিয়েছেন। সৌভাগ্যক্রমে, দেরিতে হলেও কোলকাতা জেগে উঠেছে গত পাঁচ বছরে।

কিন্তু এখনও মুনাফা লোটার ফিকির যেমন রয়েছে, তেমনই পাশাপাশি ছোট উদ্যোগের রয়েছে অপরিকল্পিত অনিয়ন্ত্রিত অপেশাদার ব্যবস্থার থেকে বাইরে বেরিয়ে আসার অনীহা। জৈব খাবার মানেই যে তা সামাজিকভাবে, প্রকৃতিগতভাবে গ্রহণযোগ্য হবে  তা নাও হতে পারে। এ প্রসঙ্গ আগেও তুলেছি। কিন্তু উত্তর দেওয়ারও একটা দায় থাকে বৈকি! তাহলে কী হবে পণ্যের সেই মাপকাঠি যা দিয়ে আমরা বুক বাজিয়ে বলতে পারব – আমিই আসল লখিবাবুর আসল সোনার আসল দোকান? আমরা নিজেরা একটা মার্কা বানাতে পারিনা?

আমার মাপকাঠিতে এগারোটি সূচক – এই এগারোটির দিকে যত এগোতে পারবেন বিক্রেতা, তত তিনি জাতে উঠবেন। আর যখন ক্রেতা এই এগারোটি সূচক যাচাই করতে, প্রশ্ন করতে শিখবে, তখনই বাজার থেকে ছেঁদো ও ছদ্ম জৈব খাবারও উধাও হতে থাকবে। হয়ত কয়েকদিনের মধ্যে সকলের জন্য এইরকম একটা মাপকাঠিতে নাম লেখানোর জায়গা তৈরি করতে পারব। তখন আরও বিস্তারিত লেখা যাবে। আপাতত খসড়া। মনে করিয়ে দিই এটি প্রাকৃতিক চাষের মানক নয় – পণ্যের মানক।

গুনগত মানের সূচক –

১) আমার পণ্যে কোন কৃত্রিম উপাদান নেই (There is no synthetic input in my product) – ব্যাখ্যা করে বললে, এই খাবারে কোন কৃত্রিম প্রিজার্ভেটিভ / পোকা দমনের ওষুধ / খাবার মিষ্টি করার যৌগ / স্বাদবর্ধক / রং  নেই, কোন ভেজালও নেই।

২) আমার পণ্য খাঁটি (My product is pure) –মানে বেশি প্রসেসিং করা হয়নি, অন্য জিনিস বেশি মেশানো হয় নি – পণ্যের মূল স্বাদ, রং, গঠন প্রায় একই আছে। মানে টমেটো সসে টমেটো ছাড়া আর কিছু নেই।

প্রাকৃতিক মানের সূচক –

৩) আমার পণ্য বেশি দূর থেকে আসেনি (I ensure low travel distance) – আমি চেষ্টা করেছি ১৫০ কিমির মধ্যে থেকে খাবার নিয়ে আসতে। কার্বন ফুটপ্রিন্টের কথা শুনেছেন নিশ্চয়।

৪) আমি যথাসম্ভব কম ও নিরাপদ প্যাকেজিং করেছি (I use minimum but safe packaging) – টেট্রা প্যাক নয়, যথা সম্ভব কম প্লাস্টিক। যারা দোকান থেকে বিক্রি করছেন তারা প্রায় বিনা প্লাস্টিকে চলে যেতে পারেন। কিন্তু ডেলিভারি করলে অসুবিধা, তেমনি কিছু কিছু পণ্য (যেমন হলুদ) কাগজে রাখা সম্ভব নয়। তাঁর উপরে চাল ডালে পোকা লেগে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সুতরাং নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে নতুন ধরণের পাত্রে রাখা ও দেওয়া নেওয়ার। পোকা ধরার ক্ষেত্রে অবশ্য আপনার পণ্যের দানায় কতটা ময়েশ্চার আছে সেটাও একটা জরুরী ব্যাপার।

৫) আমি যথা সম্ভব পরিবেশবান্ধব জ্বালানী ব্যবহার করেছি (I use renewable energy in processing and preservation)

৬) আমার পণ্য প্রাকৃতিক (My products are natural/ecological) – এই পণ্য অচাষযোগ্য, জংলী, পি জি এস সার্টিফায়েড, পেস্টিসাইড/হার্বিসাইড/ফাঙ্গিসাইড দেওয়া হয় নি। এমনকি রাসায়নিক সারও দেওয়া হয়নি বা কমানোর চেষ্টা হচ্ছে। আপনি চাইলে চাষের জমি দেখে আসতে পারেন। মাটির তলার জল তুলে চাষ করা হয়নি। সারও কৃষক নিজে বানিয়েছেন।

৭)  আমি যেখান থেকেই পণ্য এনেছি সেখানে ফসল ফলানোর ও তোলার সাধারণ প্রাকৃতিক নিয়ম মানা হয়েছে (I ensure sustainable harvesting) – অর্থাৎ আমার সব পণ্য মরশুমি, কখন কতটা ফসল তুলব তা প্রাকৃতিক নিয়ম মেনে চলে। একবারে সব মুড়িয়ে কেটে আনা হয় না। যেমন মধুর ক্ষেত্রে মৌচাক সম্পূর্ণ ধ্বংস করে মধু আনা হয় না।

সামাজিক সূচক –

৮) এই দেখুন, লেবেলে সব লেখা আছে (Product label contains all info) – পিজিএস নম্বর, এফএসএসআই, পুষ্টির তথ্য, উৎস, কী করে আমি আসল উৎপাদকের কাছে যাব, অভিযোগ থাকলে কোথায় জানাব।

৯) আমি দাম ঠিক করার ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ স্বচ্ছ (I follow transparency in pricing) – অর্থাৎ ক্রেতার কাছে পরিষ্কার যে কেন এই দাম ঠিক হয়েছে, ৬০~৭০% দাম আসলে উৎপাদকের কাছে ফিরে যাবে। কোন জিনিসের দাম কী ভাবে ঠিক করা হবে তার মোটামুটি একধরণের নিয়ম আছে। আপনার পণ্য তথাকথিত ‘জৈব’ বলেই আপনি আকাশছোঁয়া দর হাঁকবেন – তার কোন মানে নেই।

১০) এই পণ্য উৎপাদনে শ্রম আইন মেনে চলা হয়েছে (I use fair labour)  – জাতি লিঙ্গ হিসাবে মাইনের কোন হেরফের করা হয়নি, শিশু শ্রমিক ব্যবহার করা হয়নি, ন্যূনতম মাইনে দেওয়া হয়েছে, শ্রমিক বা কর্মচারিকে ঠিকঠাক ছুটি দেওয়া হয়েছে ইত্যাদি।

১১) উৎপাদনের পদ্ধতি বা উৎপাদকের উপরে আমার মালিকানা ভিত্তিক নিয়ন্ত্রণ নেই (The production process is not owned by a buyer) – কৃষকের উৎপাদন ব্যবস্থাকে আমি জোর খাটিয়ে বদলাইনি, কৃষক পরিচালিত সমবায় থেকে জিনিস নিয়ে আসি। এটা খুব জরুরী – তা না হলে ব্যাবসাদারদের মাধ্যমে উৎপাদকের শোষণের একটা সম্ভাবনা থেকেই যায়।

এই এগারোটা সূচকের দিকে পৌঁছতে চাওয়া উচিত যতটা সম্ভব। হয়ত কিছু কিছু আপনি করে ফেলেছেন, কিছু কিছু খামতি আছে। এগুলোই একদম ঠিকঠাক হয়েছে, তা নাও হতে পারে – তর্ক বিতর্ক থাকতেই পারে – কিন্তু যারা তথাকথিত ‘জৈব’ খাবার বিক্রি করছেন – তারা সত্যি সত্যি একটু ভেবে দেখুন তো আপনি আদও এসব নিয়ে ভেবেছেন কিনা। আর যারা কিনছেন – তারাও ভাবুন ঠিক কী কিনতে চাইছেন আপনি? শুধু বিক্রেতার ঘাড়ে দায় ও দোষ চাপালে সচেতন ক্রেতা হয়ে উঠবেন কি করে?

খাবার ও বাজার

————————————————————————————————————

কী কিনবেন, কেন কিনবেন

আজ নজর দেওয়া যাক আপনার আমার মত ক্রেতাদের দিকে।  যদি ‘জৈব’ খাবার দাবার কিনতে চান তবে ছদ্ম জৈবর থেকে বাঁচার রাস্তা বলেছি আগের বার। কিন্তু সকলের হয়ত সেই সুযোগ নেই – আশপাশের পাড়ার বাজার থেকেই কিনে খেতে হয়। হয়ত সবসময় জৈব খাবারের দোকানে যাওয়ার সুযোগও হয়ে ওঠে না। একটা সময় ছিল বাড়িতে তো সাধারণ বাজার থেকে আনা খাবারই খাওয়া হত – খাবারে বিষ-ভেজাল তো নিতান্ত হাল আমলের কথা। একটু ভেবেচিন্তে দেখা যাক বাজার থেকেই বা নিরাপদ খাবার কী দেখে কিনব।

ফল সবজি – 

মরশুমি সবজি কিনুন – গরমকালে ফুলকপি, টমেটো, পালং, বিট, বাঁধাকপি আর শীতকালে পটল, ভেন্ডি, ঝিঙ্গে খুঁজবেন না। অসময়ের সবজিতে পোকামারা বিষ বেশি দিতে হয়। লাল নীল ক্যাপ্সিকাম, জুকিনি, নিউজিল্যান্ডের প্লাস্টিকের স্কার্ট পরা লেবু  – বিদেশ থেকে আসা খটো মটো নামের ফল সবজি থেকে দূরে থাকুন। ক্যানড সবজি নৈব চ।  বরং নজর দিন থোড়, মোচা, কাঁচকলা, সজনে পাতা-ফুল-ডাঁটা, পেঁপে, ডুমুর, কচু, ওল, নিম পাতা, ফলসা, নোড়, বাতাবি, নোনা, কামরাঙ্গা – এইসবের দিকে। এসব কেউ ‘মন’ দিয়ে ‘যত্ন’ করে চাষ করে না। আরও ভালো অচাষের জংলী এলোমেলো ফসল – হিঞ্চে, জলকলমি, শুষনি, আমরুল এইসব। টাটকা সবজি ফলের একটা শক্তপোক্ত আঁটোসাঁটো ব্যাপার থাকে – বাসি হলেই নরম, এলানো গোছের হয়ে যায়। কিন্তু দেখতে হবে তা আবার অতিরিক্ত রঙিন, অতি চকচকে না মনে হয় – দু চারটে পোকা থাকলে ক্ষতি নেই। আম-কলায় যদি ছিট ছিট দাগ থাকে তবে তো ভালোই – কার্বাইড না থাকার একটা সম্ভাবনা থাকে। ছোট মাটিতে বসা সব্জিওয়ালার কাছ থেকে কিনতে পারেন – হয়ত সে নিজেই ফলিয়েছে কিছু কিছু। কথায় কথায় উৎস সম্পর্কে জেনে নিলে খুশিই হবেন তিনি। পুষ্টির কথা ভাবতে গেলে নানা রং-এর ফল সবজি কেনাই ভালো। আরো ভালো, যদি সাজিয়ে তুলতে পারেন এক টুকরো বাগান – যাতে অন্তত কাঁচা খাওয়ার পাতা ফুল ফল আপনি ফলিয়ে নিতে পারেন নিজের হাতে।

চাল ডাল – 

স্থানীয় ভাবে তৈরি জিনিস কেনার চেষ্টায় থাকুন – বিদেশী ইম্পর্টেড জিনিস থেকে দূরে থাকুন। কর্নফ্লেক্সের থেকে চিঁড়ে, মুড়ি, খই কম কিসে? এখনও বাজারে নানা রকম গোটা ডাল পাওয়া যায় (এই যেমন রমা কলাই, বরবটি কলাই, সীম বীচি) – চেষ্টায় দোষ নেই। বরং এক রকম ডাল খাওয়ার থেকে সপ্তাহে তিন রকম ডাল খাওয়া ভালো। তবে মুগ-মুশুরের ক্ষেত্রে বড় দানার থেকে ছোট দানা ভালো। যদি জানতে পারেন – তবে কানাডা বা অস্ট্রেলিয়া থেকে আসা যে কোন ডাল সম্পর্কে সাবধান। ঝকঝকে পরিষ্কার চাল ডালও বেশ ক্ষতিকর – উপরে একটু খোসা, চালে একটু লাল লাল দাগ – শরীরের জন্য দাগীই ভালো। আর যদি মুখে জটিল শর্করা রোচে তো রাগি, জোয়ার, বাজরা – নিদেন চিনির বদলে গুড় খেয়ে দেখতে পারেন। তবে গূঢ কথা হল গুঁড়ো করা জিনিসের প্যাকেট পড়ে নেবেন – হয়ত দেখলেন উপরে বড় বড় করে লেখা পালটি বাবাজীর মাল্টিগ্রেন আটা – আসলে পাঁচ পারসেন্ট মাল্টি আর বাকিটা সাধারণ আটা।

মাছ মাংস ডিম – 

মেছো বাঙালির মাছের বাজার পুরোটাই মছলী বাবার মত ভেকধারী। কাটাপোনা থেকে দূরে থাকুন – ওগুলো বরফে আর ফর্মালিনে মাছের লাশ, মাছ নয়। ভালো হয় যদি জ্যান্ত মুরগী, জ্যান্ত মাছ কিনতে পারেন। আরো ভালো হয় যদি দেশী (বা ছেড়ে পোষা, চরে খাওয়া) মুরগী, দেশী মাছ কিনতে পারেন। শামুক, ঝিনুক, কুচো চিংড়ি, বান, বোয়াল, খয়রা, চাঁদা, ট্যাংরা, পুঁটি, বোগো, শাল, শোল, ল্যাঠা, খলসে – মাছের কি অভাব নাকি! বাঙালীর প্রাণ যে কাটা রুই কাতলায় আটকে রইল! যদি মরা মাছ কিনতেই হয় – হাত দিয়ে দেখুন, গা হবে পিছল, চোখ পরিষ্কার চকচকে, অক্ষত পাখনা। কানকো লাল হবে, তবে তা ঠকানোর অনেক রাস্তা বেরিয়ে গেছে এখন। বেশি লাল আবার সন্দেহ জনক। ক্যানড ফিশের দিকে আবার হাত বাড়াবেন না যেন – একদম মৌলিক ফর্মে মাছ, মাংস কেনার চেষ্টা করুন, কাটা ধোয়া ভিনিগারে ভেজানো পিস করার দিকে নাই বা গেলেন। দেশী মুরগী, হাঁসের ডিম খান। কম খান – কিন্তু ভালো খান – একটু দাম না হয় দিতেই হল। সপ্তাহে তিনদিন পোলট্রি মুরগীর থেকে এমনকি মাসে একদিন ছাগল খাওয়াও ভালো।

এত কিছু করেও আপনি প্যাকেটের কাছ থেকে মুক্তি পাবেন বলে মনে হয় না – তবে প্যাকেটের চিপস কুড়কুড়ে আর শীতল পানীয়র শিকল থেকে মুক্ত হওয়াটা জরুরী – ওতে পুষ্টি নেই, শুধু ক্যালরি। প্যাকেটের সামনের রং চং স্লোগান দেখে ভুলবেন না – উল্টোদিকে কী লেখা আছে তাতে নজর দিন। ইনগ্রেডিয়েন্ট বেশী থেকে কমের দিকে লেখা – যা সব থেকে উপরে তা সবথেকে বেশি পরিমাণে আছে – যদি তা যদি পণ্যের সঙ্গে না মেলে – তবে তা না নেওয়াই ভালো। অর্থাৎ ম্যাঙ্গো ড্রিংকের তালিকায় সবার উপরে থাকে উচিত আম।  আর ইনগ্রেডিয়েন্ট – এর তালিকায় যদি ৫~৬ টা জিনিসের থেকে বেশি জিনিস থাকে তবে তা পরিহার করাই ভালো – কারণ তা ওভারপ্রসেসড। আরকী দেখবেন? দেখুন – কতদিন অবধি ব্যবহার করা যাবে, কে বানিয়েছেন, কে প্যাক করেছেন, কোথা থেকে আসছে (বেশি দূর মানে বেশি প্রিজার্ভেটিভ, বেশি বাসি হওয়ার সম্ভাবনা), কবে তৈরি, এফএসএসআই নাম্বার এই সব।

বাজার করার আর কি ম্যাজিক আছে আপনার ভাঁড়ারে – বলে ফেলুন। জেনে বুঝে সমৃদ্ধ হই।

গত পাঁচ পর্বে খাবারের বাজার আর বাজারের খাবার নিয়ে বিস্তর বক বক হল। যারা পড়লেন – ধন্যবাদ। যারা পড়লেন না, এড়িয়ে গেলেন – তাদেরও অনুরোধ – না পড়লেন না পড়লেন, কিন্তু খাবার নিয়ে ভাবতে থাকবেন অন্তত। কারণ খাবার-জল-হাওয়াই আপনাকে বাঁচিয়ে রেখেছে – এই তিনটে তে গড়বড় হলে আপনার জীবন নড়বড়ে হয়ে যাবে।

খাবার ও বাজার

1 Comment

  • অসাধারণ। মনোমুগ্ধকর। জৈব চাষ সম্পর্কে আরও জানতে চাই।

Leave a Comment