জলবায়ু পরিবর্তন একটি ক্রমবর্ধমান বিপদের নাম এবং কেমন হবে যদি আমরা পুরোপুরি হাত গুটিয়ে বসে থাকি, যদি আমরা কিছুই না করি, যদি একই রকম ভাবে গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমন করতে থাকি। বিজ্ঞানীরা এই ক্রমবর্ধমান বিপদের একটা ধারনা দিচ্ছেন আমাদের যেখানে ২১০০ সালে পৃথিবীর অবস্থা কেমন হবে তাই নিয়ে একটা অনুমান করা হয়েছে। এখন কথা হচ্ছে সেই অনুমান মেলার সম্ভাবনা কতটা ? চোখ বন্ধ করেই বলা যায়, সেই অনুমান অভ্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। আসুন আমরা দেখে নি, যদি আমরা কিছু না করি কেমন হবে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পৃথিবীর অবস্থা। এই অনুমানগুলি আইপিসিসি রিপোর্ট বা অন্যান্য অসংখ্য গবেষণামূলক প্রবন্ধে প্রকাশিত বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের ওপর ভিত্তি করে করা হয়েছে।
সাল ২১০০ – আগুন, ধোঁয়া আর তাপপ্রবাহ
মনে করুন টাইম মেসিনে করে আমরা চলে গেছি ২১০০ সালে, সেখানে অবস্থা আমাদের দুঃস্বপ্নের থেকেও খারাপ। ইতিমধ্যে, সারা পৃথিবীর তাপমাত্রা শিল্প বিপ্লবের তুলনায় ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে গেছে। অনেক দেশেই রোজকার তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে যাচ্ছে। ভারত বা বাংলাদেশের মত অঞ্চলে গ্রীষ্মকালে তাপপ্রবাহ নিত্য নৈমিত্তিক ব্যপার হয়ে গেছে। তাপমাত্রা ৫০ ডিগ্রি ছাড়িয়ে যাচ্ছে প্রায়শই। গরমকাল শুরু হলেই পৃথিবী জুড়ে জঙ্গলগুলোয় আগুন লাগছে, ধোঁয়ায় শ্বাস নেওয়া দায় হয়ে পড়েছে। বড়লোকের ঘরে ঘরে অক্সিজেনের সিলিন্ডার। বায়ু দূষণের ফলে মৃত্যুর সংখ্যা একধাপে অনেকগুন বেড়ে গেছে, ডেথ সার্টিফিকেটে লেখা হচ্ছে মৃত্যুর কারন বায়ু দূষণ।
সাল ২১০০ – সমুদ্রে কবরখানা
সমুদ্রের তাপমাত্রা আর এসিডিটি বেড়ে গিয়ে লাখে লাখে কোরাল মারা যাচ্ছে, গ্রেট বেরিয়ার রিফ কবেই ধ্বংস হয়েছে আর তার সাথে বিলুপ্ত হয়েছে সেই খানে থাকা কয়েক লক্ষ্য মাছ এবং সামুদ্রিক জীবের প্রজাতি। আর্টিক সমুদ্রে আর বরফ নেই, বরফ গলতে শুরু করেছে আন্টার্টিকা এবং গ্রীনল্যান্ডের। প্রতিদিন কয়েক লক্ষ কোটি গ্যালন জল সমুদ্রে মিশছে। সমুদ্রের জলের তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার ফলে সমুদ্রের জলের আয়তন বৃদ্ধি পেয়েছে। এই দুইএর মিলিত প্রভাবে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্ছতা বেড়ে গেছে কয়েক মিটার। হংকং, মালদ্বীপ, মিয়ামি, রিও, মুম্বাই এর মত সমুদ্র পার্শ্ববর্তী শহরগুলি আর নেই, বন্যার ফলে ভেসে গিয়েছে ভারত এবং বাংলাদেশের সমুদ্র তীরবর্তী বিস্তীর্ণ অঞ্চল। মালদ্বীপ আন্দামানের মত ছোট ছোট দ্বীপগুলির কথা আর নাই বা বললাম।
পাহাড়চুড়ায় আতঙ্ক, বন্যা খরা
হিমালয়ের বেশিরভাগ বরফ গলে গিয়ে হিমবাহ পুষ্ট নদীগুলির জলপ্রবাহ কমিয়ে দিয়েছে। গঙ্গা, সিন্ধু, ব্রহ্মপুত্রের অববাহিকার কোটি কোটি মানুষের খাবার বা চাষের জলের হাহাকার নিয়ে খবর হচ্ছে প্রতিদিন। বাংলাদেশের ২০ শতাংশ অঞ্চল এখন জলের তলায়। দার্জিলিঙের মানুষ ঘরে এসি বসাচ্ছেন আজকাল। স্কি করতে হলে কম্পিউটারই ভরসা কারন আর বরফে ঢাকা পাহাড় শুধু ছবিতেই দেখা যায়। আম্ফানের পূর্বাভাস নিয়ে আর কেউ মাথা ঘামায় না, ২০০-৩০০ কিলোমিটার গতির ঝড় এখন এত বেশি হচ্ছে যে তাদের নামকরন এখন সংখ্যা দিয়ে করা হয়।
বর্ষা আর মাছে ভাতে বাঙালি
বর্ষাকালেও চাষের জন্যে ভূগর্ভস্থ জলের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। দক্ষিন পশ্চিম মনসুন এখন প্রায়ই অতি বৃষ্টি বা অনাবৃষ্টি ঘটাচ্ছে। বৃষ্টির জলের ওপর আর ভরসা রাখা যাচ্ছে না, ফসলের উৎপাদনে সাংঘাতিক পরিবর্তনে এসেছে। প্রায়শই প্রয়োজনের তুলনায় কম ফসল উৎপাদন হয়। বাড়ছে পোকার উপদ্রব। শীতের সবজি বাজার থেকে উধাও হয়ে গেছে। সাথে সাথে, বিস্তীর্ণ অঞ্চলের কৃষিজমি স্রেফ চাষবাসের অযোগ্য হয়ে গেছে। ভূগর্ভস্থ জলের অভাবে রেশন করে দেওয়া হচ্ছে জল। প্রয়োজনের তুলনায় কমছে মাছের উৎপাদনও। সমুদ্রের এসিডিটি বেড়ে যাওয়া এবং বাসস্থান ধ্বংসের কারনে সামুদ্রিক মাছের মুচমুচে ভাজা আর বাঙ্গালির পাতে পড়ে না।
মৃত্যু, মন্বন্তর এবং রিফিউজি
যুদ্ধ বা অন্যান্য কারনে না, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে উদ্বাস্তু মানুষের সংখ্যা সর্বাধিক। ভিটে মাটি ছেড়ে প্রতিদিন লাখ লাখ মানুষ কাজ, খাবার আর জলের সন্ধানে পাড়ি দিচ্ছে বহুদুর। লোক মরছে টিবি, ম্যালেরিয়া, ডাইরিয়া বা কলেরায়, মড়ক লেগেছে চারিদিকে। প্রবল ঝড় বা বন্যায় এক ঝাঁকে মারা যাচ্ছে লাখ লাখ মানুষ। পৃথিবীর মানুষ দুভাগে ভাগ হয়েছে বহুদিন, মুষ্টিমেয় সামর্থ্য থাকা মানুষ কৃত্তিম ভাবে বাসা বানিয়ে এখনও সুখ সাচ্ছন্দ উপভোগ করছে আর বেশির ভাগ মানুষ অপেক্ষা করছে কত তাড়াতাড়ি তারা তাদের জীবন শেষ করবে।
জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে এবং মানুষের জন্যেই হচ্ছে। এখনও সময় আছে, আসুন আমরা লড়াই করি একসাথে। নইলে শেষের সেদিন ভয়ঙ্কর।
প্রচ্ছদের ছবি: অর্ঘ্য মান্না ও সোমদত্তা কারক