কলমে : বকুল চন্দ্র বর্মন, সবুজ পৃথিবী
পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশে বেশিরভাগ সময়েই আকস্মিক বন্যায় জীবনমান বিপর্যস্ত হয়, নষ্ট হয় ফসল। অন্যদিকে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে তাল মিলিয়ে কমে যাচ্ছে আবাদি জমি, ভরাট হচ্ছে খাল বিল, নদী নালা পুকুর। “মাছে ভাতে বাঙালি” প্রবাদটিই যেন এখন হুমকির মুখে। বর্ষাকালে ক্ষেতে, খালে, বিলে প্রচুর দেশীয় মাছ পাওয়া যেত কিছু দশক আগেও। এখন আর পাওয়া যায় না, অনেক মাছ বিলুপ্তির পথে। এখন বেশ চ্যালাঞ্জিং হয়ে দাড়িয়েছে অল্প জমিতে কি করে বেশি ফসল উত্পাদন করা যায়। বেশি লাভবান হওয়া যায়।পরিবারের চাহিদা মিটিয়েও অর্থ লাভ করা যায়।সেদিক বিবেচনায় পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ হতে পারে ধান ও মাছের সহচাষ এর জন্য আদর্শ জায়গা, যার মাধ্যমে পৃথিবীর অনেক দেশেই এই ব্যবস্থায় মাছের অভ্যন্তরীণ চাহিদা ও ফসলের চাহিদা মেটাচ্ছে।
কেন করবেন ধান ও মাছের সহচাষ?
১। অল্প জমিতে বেশি লাভ
২। বেশি জমি নেই পুকুর কেটে মাছ চাষ করার মত, সহচাষ করুন পুকুর এর জন্য আলাদা জমির প্রয়োজন পড়বে না।
৩। বন্যায় ধান নষ্ট হয়, সহচাষে বন্যা সহনশীল জাত চাষ করা হয় তাই ধান নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা কম।
৪। একই সাথে ধান এবং মাছ চাষ করে বেশি অর্থ ঘরে আনা যায়।
৫। ধান চাষের জন্য অতিরিক্ত সার/বালাইনাশক কোন প্রয়োজন নাই।আর্থিক সাশ্রয় হয়।
৬। মাছ চাষের জন্য অতিরিক্ত খরচ নেই।
৭। পরিবারের আমিষের চাহিদা পূরণ হয়।
৮। প্রতিবার নতুন করে জমিতে পুকুর প্রস্তুত করার ঝামেলা নাই। একবার করলে কয়েক বছর নিশ্চিন্ত।
৯। ধানের কীটপতঙ্গ মাছে এ খেয়ে ফেলে।
১০। আগাছা হয় না বললেই চলে।
১১। ধানের জমির পুষ্টিমান মাছ চাষে কাজে লাগে
১২। ধানের ক্ষতিকর পোকামাকড় কম হয়।
১৩। আগাছা নিধন করার জন্য যে খরচ পড়ে তা বেঁচে যায়। আগাছা নিধনের জন্য যে কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয় তা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। এতে পরিবেশ ও রক্ষা পায়।
১৪। মশা বাহিত অনেক রোগ মানুষের জন্য বিপজ্জনক। ধান ও মাছের চাষ এ মশার উত্পাদন রহিত হয়, যা মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করে।
কিভাবে করবেনঃ
সহচাষ পদ্ধতিতে ধান ও দেশি মাগুর চাষের জন্য কয়েকটি ধাপ অবলম্বন করতে হয়:
জমি চয়ন: জমির মাটি পলি হলে তা ধান ও দেশি মাগুর চাষের জন্য বেশি উপযুক্ত
ধানের জাত চয়ন:
যেহেতু জমিতে বন্যার মত পরিবেশ বিরাজ করবে তাই বন্যা সহনশীল জাতের ধান চাষ করতে হবে।
ধানের জাতঃ হরমাননা, জলধাপা, কালিরায় ,কুমরোগোরে, সাদাজাবরা(পশ্চিমবঙ্গ)
ব্রি ধান ৫১ ও ব্রি ধান ৫২ (বাংলাদেশ)
মাছের জাতঃ দেশী মাগুর Clarias magur (পরিবার Clariidae)
এরা পরিষ্কার পানি, ঘোলা পানি, মেঘাচ্ছন্ন আবহাওয়া ও কম অক্সিজেন যু্ক্ত পানিতেও বেঁচে থাকতে পারে ও বৃদ্ধি ভালো হয়। এই মাছ রাতে সক্রিয় থাকে এবং খাদ্য খায়(পোকামাকড় , পোকার লার্ভা, মশার লার্ভা ইত্যাদি)। গ্রীষ্মের শেষে এবং বর্ষাকালে দেশী মাগুর ডিম ছাড়ে এবং কয়েক মাসের মধ্যে ৩৫ সে.মি দৈর্ঘের হয় ও ওজনে প্রায় ২৫০ গ্রাম পেরিয়ে যায়।
পদ্ধতি:
পুকুর খননঃ পুকুরের দৈর্ঘ ৬০ ফুট , প্রস্থ ৩০ ফুট বা সুবিধার্থে কম বেশি হতে পারে। এপ্রিল -মে মাস এ পুকুর প্রস্তুত করতে হবে । পুকুরের গভীরতা ২ ফুট থেকে ৪ ফুট পর্যন্ত হতে পারে।
ধান বপন: ধান ছিটিয়ে বপন করতে হবে। এজন্য জুন মাসের ১ম সপ্তাহ থেকে ৩য় সপ্তাহ পর্যন্ত পুকুরের ওপরের স্তর প্রথম বৃষ্টি হওয়ার পর প্রস্তত করে..ধান ছিটিয়ে দিতে হবে।ধানের পরিমাণ হবে ৩০ গ্রাম/ ৩৬ স্কয়ার ফুট।
মাছের পোন অবমুক্ত করণঃ জুন -জুলাই তে পুকুরে পানি জমা হলে মাছের পোনা অবমুক্ত করতে হবে। ৬০*৩০ স্কয়ার ফিট এ প্রায় ৫০০ পোনা খুব সহজেই চাষ যোগ্য।
মাছের খাবারঃ মাগুর এর জন্য ফিস ফিড ৫০ কেজি(৬-৮মাস)। মাছের খাবার এবং ধানের জৈব সার হিসেবে এজোলা(Azolla) ব্যবহার করলে ধান ও মাছের উত্পাদন বৃদ্ধি পাবে।
ফলাফল:নভেম্বর মাসে ধান পাকলে তা সংগ্রহ করে নিতে হবে। ধানের উত্পাদন প্রায় ৫০-৬০ কেজি / ১৮০০ স্কোয়ার ফিট(৪ শতক প্রায়)
৫ মাসে মাগুর মাছ প্রায় ২০ সে.মি -৩০ সে.মি হতে পারে এবং ওজনে ১২৫ গ্রাম থেকে ২৫০ গ্রাম পর্যন্ত হতে পারে।
মাছের উত্পাদন ৪০-৫০ কেজি /১৮০০ স্কয়ার ফিট
খরচ: পুকুর খননে এক্সক্যাভেটর ১২০০টাকা/ঘন্টা* ২ ঘন্টা=২৪০০ টাকা
অথবা শ্রমিক ৪০০টাকা/পার হেড *৬ জন=২৪০০ টাকা
ধানের বীজ ৩০-১০০ টাকা/কেজি*১.৫ কেজি=৪৫-১৫০ টাকা
মাছের চারা ৩-৫ টাকা/প্রতি পিচ *৫০০= ১৫০০ টাকা
মাছের ফিড ৫০-৬০ টাকা/কেজি*৫০ কেজি=২৫০০-৩০০০ টাকা
বিবিধ(নেট,সার ইত্যাদি): ১০০০ টাকা
সর্বমোট: ৭৪৪৫-৮০৫০ টাকা ৪ শতকে। যা বিঘায় প্রায় ৯৩,০০০-১,০০,০০০ টাকা।(বাংলাদেশী)
[বি.দ্র. লোকালয় ভেদে এই খরচ কম বা বেশি হতে পারে এবং শুরুর খরচ বেশি হলেও পরবর্তীতে অর্থ সাশ্রয়ী, পরের বছর গুলোতে খরচ নেই বললেই চলে তুলনামূলক ভাবে।]
উত্পাদন:ধান ৬০*২২.৫টাকা/কেজি=১৩৫০ টাকা
মাছ ৫০*৪০০ টাকা/প্রতি পিচ=২০,০০০ টাকা
সর্বমোটঃ২১,৩৫০ টাকা ৪ শতকে। যা বিঘায়(৫০ শতক) প্রায় ২,৬৬,৮৭৫ টাকা(বাংলাদেশী)
লাভ: (২,৬৬,৮৭৫- ১,০০,০০০) টাকা= ১,৬৬,৮৭৫ টাকা(বাংলাদেশী) প্রায় ।
সাবধানতাঃ
১।পুকুরের পাড় উচু করে বেধে দিতে হবে
২। পুকুরের পাড় ভেঙ্গে যেন না যায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে/ ইদুরের আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে হবে।
৩। মাছের বৃদ্ধির দিকে খেয়াল রেখে মাছের খাবার এর পরিমাণ কম বা বেশি করতে হবে।
অভ্র চক্রবর্তী এবং অভিক রায়ের বৈজ্ঞানিক গবেষণার আধারে এই প্রবন্ধটি লেখা হয়েছে। মুল গবেষণার লিঙ্ক নীচে দেওয়া হল।
DOI: 10.13140/RG.2.2.35847.65440