বন্ধুদের লেখা

কৃষিকাজের কাজের সেকাল এ কাল

কৃষিকাজের কাজের সেকাল এ কাল

কলমে – মনোজ দাস

মনোজ দাসমনোজ দাস, সুস্থায়ী যাপনে বিশ্বাসী, দেশীয় মৌমাছি পালক,  প্রকৃতিক কৃষি এবং  জীববৈচিত্র রক্ষার ও দেশী বীজ সংরক্ষণ আন্দোলনের  কর্মী।

—————————————————————————————————————

১ম পর্ব

ডাল ভাত বাঙালী খাদ্য তালিকায় এক অতি পরিচিত মেনু।যদিও সারা ভারতে ডাল খাওয়ার প্রচলন আছে।আমি সেই ডাল চাষের কথায় আসছি। ডাল বোনা হত আশ্বিন মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে কার্তিকের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে।আর ফসল তোলা হত পৌষ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে মাঘ মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত। পৌঁষ সংক্রান্তির আগে মুগডাল বাজারে আনতে পারলে চাষি একটু বেশি পয়সা পেতো, কারণ টুসু পরবে এই ডাল দিয়ে চালের রুটি খাওয়া হত।যদিও এই চালের রুটির সঙ্গে মাংস

খাওয়ার চল ছিল। যাক গে যে কথা বলছিলাম, এই মুগের কিন্তু শুটি তোলা হতো না। বেশিরভাগ শুটি পেকে গেলে গাছ শুদ্ধ উপড়ে এনে রোদে শুকিয়ে গরু দিয়ে মাড়িয়ে মুগ কড়াই বের করা হতো।পরোটাই প্রাকৃতিক উপায়ে চাষ হতো, না দিতে হতো সেচ, না দিতে হতো সার-বিষ। এই মুগের দানা ছোট, রঙ কালচে সবুজ। অতি সুস্বাদু এই মুগডালের চাষ প্রায় উঠে যেতে বসেছে।

আমাদের ওখানকার এই প্রজন্মের ছেলেমেয়ের যদি জিজ্ঞেস করা হয় মুগকড়াই কোন সময় বোনা হয় প্রায় সবাই বলবে মাঘ মাসে বোনা হয়।কারন এটাই এখন প্রচলিত। এই মুগ কড়াই দুই থেকে তিন বার তোলা হয়।

এতে রাসায়নিক সার ব্যবহার করা হয় এবং কিট নাশকও ব্যবহৃতহচ্ছে।

—————————————————————————————————————

২য় পর্ব

আমরা কোন ক্লাসে পড়েছি মনে নেই।কিন্তু পড়েছি তিন মরসুমে ধান চাষহয় আমাদের দেশে। যথা আউশ, আমন আর বরো। বইতে পড়া বিদ্যের সঙ্গে বাস্তবে মেলাতে গিয়ে হোঁচট খেতাম কারন আমাদের এলাকায় তখন আউশ ধান (আশুধান) এবং আমনধান চাষ চাষ। পরে আর একটু বড় হয়ে দেখেছি বাঁশি খালের খাতে শীতকালে যখন জল কমে যেতো এক রকম বেঁটে জাতের ধান চাষ হতো। যা বরো ধান বা খরাটি ধান বলে পরিচিত।ঐ সময় শুধুমাত্র মাটির তলার জল ব্যবহর না করেই খরাটি(খরা বা গরমের) ধান চাষ হতো। পরের দিকে আমি বড় হওয়ার সাথে সাথে আমার পরিচিতির গন্ডি বেড়েছে,রোহিনীর কাছে শালবনির বেশ কিছু নীচু জমিতে যেখানে আমন ধানের বেশী জল সহ্য করতে পারে এমন ধান অল্প বিস্তর হতো সেই জমিগুলোতে এই রোবোধানের চাষশুরু হয়েছে।এদিকে পদিমা,পেটবিন্ধী, দিগারবাঁধ এর কাছে ভোলদহতে বোরোধান চাষ শুরু হয়েছে। ধীরে ধীরে বোরো ধানের চাষ পাল্লা দিয়ে বেড়েছে। এমনকি পরীক্ষামূলক ভাবে আউশধান চাষের মরশুমে বোরোধান তথা আই আর এইট,চায়না বরো ইত্যাদি উচ্চ ফলনশীল ধান চাষ শুরু হয়েছে। এবং ক্রমশ আউশধানকে উচ্ছেদ করেছে।

এখন সেই প্রকৃতি নির্ভর আউশধান পদ্ধতি প্রসঙ্গে বলার আগে বলি সে সময় গ্রামের বর্ধিঞ্চু পরিবার বাদ দিয়ে সাধারন ক্ষুদ্র চাষী থেকে ক্ষেতমজুর ও অন্যান্য সাধারন মানুষ ভাদ্রমাস এ খুব অভাবের মধ্যে থাকতেন। ভাদর মাসে আউশচাল উঠলে নবান্ন হতো।

প্রথমেই উল্লেখ করেছি,আশুধান চাষ পুরোপুরি প্রকৃতি নির্ভর। ফাগুনের শেষে বৃষ্টি হলে লাঙল দিয়ে জমি তৈরির কাজ শুরু হয়। এক চাষ দিয়ে তার পর জমিতে খত (গোবর ও কৃষিবর্জ একসঙ্গে পচিয়ে যে সার তৈরী) লাগানো (দেওয়া)হয়। এই সার ছড়িয়ে তার পর আর এক চাষ দিয়ে মই দিয়ে (চালিয়ে) জমি ফেলে রাখা হয়। তার পর আবার চৈত্র মাসের দ্বিতীয়ার্ধে কালবৈশাখীর একটি ভারী বৃষ্টি হলেই আউস ধান বুনে এক চাষ দিয়ে মই দিলেই হল।

বোনা ধানের সঙ্গে অনেক আগাছা জন্মায়। সেই আগাছা বেশি হয় জমি চাষকুঠে হলে। অথবা ধান বোনার পরে যদি বৃষ্টি বেশি হয়।

ধান বোনার পর বারো- পনেরো দিনের পর থেকে বিদা দেওয়া শুরু হয়।তার পর অবস্থা বুঝে ৫-৭ দিন ছাড়া ছাড়া ৪-৫ বার বিদা দিলেই বেশির ভাগ আগাছা নিয়ন্ত্রিত হয়ে যায়। তার পর বড়জোর একবার হাত নিড়ান দিলেই হতো। তার পর ধান পাকলে কাটতে গেলেই হতো। ভাদ্র মাসে এই ধান পাকতো।

আমাদের এলাকায় আউশধানের গোটা তিনেক রকমের ছিল।যেমন কালিআউস,নুনা,ধবোতুস্কো। নবান্নের দিন এই ধানের ভাত, চিড়ে, মুড়ি ও পায়েস হতো। অর্থাৎ নবান্নের (নুয়া খাওয়ার) দিনে নতুন ধানের চালের সবকিছু খাওয়া হতো।

কৃষিকাজ 3

—————————————————————————————————————

৩য় পর্ব

ছোটবেলা থেকে বাবার সঙ্গে চাষের কাজে হাত লাগিয়েছি। শুরুটা ছিল এরকম, জমিতে মই দেওয়ার সময় বেশি ওজন দেওয়ার প্রয়োজন হলে, বাবার দুই পায়ের ফাঁকে মই এর মধ্যিখান বসা। আবার হালকা ওজনের দরকার হলে একাই মইয়ের ওপর ভালোকরে ধরে বসা।সবজি ক্ষেতে নতুন বসানো চারায় সকাল বিকেল জল দেওয়া। তারপর ধীরে ধীরে নানা টুকিটাকি কাজ সাহায্য করতে ক্রমশ একজন দক্ষ কর্মীতে পরিনত হওয়া। এই স্কুলিং এর কোনো তুলনা হয় না।দেখেছি আমাদের এবং আশপাশের কৃষক পরিবারগুলির সারা বছরের কৃষি পরিকল্পনা। আগে আমরা জমিতে সেই সব ফসল উৎপাদন করতাম যা যা আমাদের সম্বৎসর কাজে লাগতো। যেমন,চৈত্র বেশাখে বোনা হাত আউস ধান।বোনা হতো পাট শন। সেই সময় বেগুনের বীজতলা তৈরি করা হতো,মূল জমিতে লাগানো হতো জৈষ্ঠ্যমাসে বা আষাঢ মাসের প্রথম সপ্তাহে। ভাদ্রমাস নাগাদ বেগুন ধরতে শুরু করে। এবং চলতে থাকে মাঘ ফাল্গুন পযন্ত। চাষের কাজে লাগে এমন সব কিছুই প্রায় কৃৃষকরা নিজেরা বানিয়ে নিতো। অর্থাৎ কৃষক এবং কৃষিভিত্তিক গ্রাম ছিলো স্বনির্ভর। বাজারে কোনটার বেশি চাহিদা,কোনটা বিক্রি করলে বেশি লাভ হবে এই চিন্তা তাদের তাড়িয়ে বেড়াতো না। চাল লাগবে ধান চাষ করতো।দড়ি,কাছি লাগবে তাই পাট শন চাষ করতে।তেল লাগবে তাই চাষ করতো তৈলবীজ। যেমন সরষে, তিল,রেড়ি (জাড়া),বাদাম ইত্যাদি।

সে সময় বছরে একটা মরসুমেই বাদাম চাষ হতো। সাধারণত জৈষ্ঠ্যমাসে বাদাম লাগানে হতো আশ্বিন মাসে বাদাম তোলা হতো। লাগানো হতো লাইন করে।সারি থেকে সারির দূরত্ব দু”ফুট বা দূফুটের চেয়ে একটু বেশি ৷ এবং একটি চারা আর একটি চারার দূরত্ব একই।বাদাম গাছ পরিনত হলে সারা জমি ঢেকে যেতো এবং প্রত্যেক গাঁট থেকে একাধিক শেকড় বের হতো।আর মাটির তলায় গাঁটে বাদাম ফালতো। আজকাল বাদাম চাষ হয় একাধিক বার। ঐ প্রজাতি হারিয়ে গেছে। এখনকার বাদাম গাছ আগের মতো ঝাঁকড়া হয়ে লতিয়ে যায় না।তাই লাগানো হয় কাছাকাছি। এখন চারা থেকে চারার দূরত্ব ও কম।দুটো লাইনের মধ্যে দূরত্ব এক ফুট মতো। এখন বিঘা প্রতি বাদামের ফলন তুলনামূলক ভাবে বেশি। আর বীজ, রাসায়নিক সার,কীটনাশক, সেচ সব মিলিয়ে উৎপাদন খরচ অনেক বেশি।

কৃষিকাজ 2

—————————————————————————————————————

৪থ পর্ব

গত শতকের নয়ের দশকের কথা। সে সময় আমার বাপ-ঠাকুরদারা ফসল চক্র মেনে চলতেন। একই জমিতে একই জাতীয় ফসল বরাবর ফলাতেন না। এ বছর যে জমিতে বেগুন ফলাতেন পরের বছর সেই জমিতে বেগুন বা লঙ্কা জাতীয় কিছু চাষ করতেন না। আগামী বছর যে জমিতে আখ লাগানো হবে সেই জমিতে এবছর বাদাম চাষ করা প্রায় বাধ্যতামূলক ছিল। কারন বাদাম যে জমিতে চাষ করা হয় সেই জমির উর্বরাশক্তি বৃদ্ধি পায়,জমি নাইট্রোজেন সমৃদ্ধ হয়। আর আখের জমির মাটি খুব উর্বর হওয়া দরকার। আখ প্রায় এক বছরের ফসল।

এই চাষের ইতিবৃত্ত লেখার আগে একটি গল্প বলি।

আখ চাষের একজন ম্যানেজার থুড়ি দেবতা ছিলেন।তাঁর নাম পঁড়াসুরা।সে ছিল অকৃতদার। কারণ!তার কোনো সময় ছিল না।মাঘ ফাল্গুন মাস খুব বেশি হলে বৈশাখের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে জমিতে আখ লাগানো হতো।আর কাটা শুরু হয় পৌষ মাসের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে। আখ কেটে আখশালে নিয়ে আসা হয়।সেখানে মাড়িয়ে/পিষিয়ে রস বের করে সেই রস জাল দিয়ে ছেঁকে, বড় উনুনে জাল দিয়ে গুড় তৈরি হয়।গুড় ঘরে তুলেই চারা তৈরির কাজ শুরু। এই সমস্ত কাজের বা নাটের গুরু পঁড়াশুরার সারা বছর কাটে এই ভাবে,প্রথমে পুহাগাড়ি ( বীজতলা ) তারপর মূল জমিতে, তারপর আখশাল। এভাবে বছরের পর বছর কেটে যায়, পঁড়াশুরার বিয়ে কর হয় না।তাই আমাদের দিকে কেউ বিয়ে না করলে তাকে ব্যঙ্গ করে পঁড়াশুরা বলা হয়।

আবার চাষের কথায় ফিরি। আখ চাষ যখন আমাদের এলাকায় শুরু হল তখন যে পদ্ধতিতে চাষ হতো তা ছিলো বেশ পরিশ্রমের, তখন একজন বড়ো চাষি এক-দু বিঘা জমিতে আখ লাগাতো। পরের দিকে এক সহজ পদ্ধতি আবিষ্কৃত হলো, আখের চাষ বানিজ্যিক /অর্থকরী ফসল হিসেবে পরিগনিত হলো। আগে আখের রস বের করার মেশিন গরু দিয়ে ঘোরানো হতো পরে আখের চাষ ব্যপক বিস্তার লাভ করায় আখ পেষাই মেশিন ঘোরানোর জন্য ১০-১২ অশ্বশক্তির ডিজেল ইঞ্জিনের প্রয়োজন হলো। কয়েক দশক ধরে সুবর্ণরেখা নদীর ধার বরাবর বিস্তীর্ণ এলাকায় এই চাষ হতে লাগলো। যত দিন যেতে লাগলো মাটি কর্ষণের জন্য গরু টানা লাঙলের পরিবর্তে ট্রাক্টরের ব্যবহার শুরু হলো। শুরু হলো আখ চাষে রাসায়নিক সারের ব্যপক ব্যবহার, পক্ষান্তরে কমতে লাগলো গোবর সারের প্রয়োগ।

আধিক লাভের আশায় নাগাড়ে বিরতিহীনভাবে বছর বছর ধরে এই চাষ হওয়ার ফলে কমতে লাগলো জমির উর্বরা শক্তি, তার প্রতিকারে রাসায়নিক সারের ব্যবহার উত্তরোত্তর বাড়ানো চলল। আখ চাষে রোগ-পোকার প্রকোপ বাড়তে লাগলো। প্রতিকার হিসাবে আরও আরও কীটনাশক প্রয়োগ করেও শেষরক্ষা হলো না। গুড়ের গুনমান কমতে লাগলো। এই অর্থকরী চাষ অলাভজনক হতো শুরু করলো। গোদের উপর বিষফোড়া দলমার হাতির আনাগোনা ক্রমশ বাড়তে লাগায় আখ চাষ ঐ

এলাকায় বিলুপ্ত হলো।

—————————————————————————————————————

৫ম পর্ব

শৈশবের দিকে ফিরে তাকালে যতদূর পর্যন্ত দেখা যায় সে সময় অর্থাৎ আমার বয়স যখন ৮-৯ বছর তখন আখের চাষ হতো।কিন্তু বানিজ্যিক ভাবে নয়।

আখের অঙ্গজ জননের মাধ্যমে চারা তৈরি হয়।এর প্রতি গাঁটে চোখ থাকে।মাটিতে বসিয়ে দিলে সেই চোখ থেকে চারা তৈরি হয়।সাধারনত আখ গাছের ডগার দিকের এক থেকে দেড় ফুট অংশ কেটে নিয়ে পুহাগাড়িতে(চারা তৈরির যায়গা) বসিয়ে চারা তৈরি করা হতো। এক্ষেত্রে ডগার অংশ ব্যবহার করা হয় কারণ এই অংশের রস পানসে সাদের হয় বা কম মিষ্টি হয়।এই অংশের রসে চিনির শতকরা হার কম হয়।

প্রথমে একফুট গভীর একটি আয়তাকার বা বর্গাকার গর্ত তৈরি করা হয়। তার আয়তন চারার পরিমানের উপর নির্ভর করে, যত বেশি চারা তৈরি হবে গর্তের মাপ তত বড় হবে। তারপর গর্তের তলদেশ ঝুরঝুরে করে কুপিয়ে নিতে হবে।গভীরতা ছয় থেকে আট ইঞ্চ মতো হবে। তাতে পর্যাপ্ত পরিমাণে জৈব সার দিতে হবে। পরিমান মতো ছাই ও বালি মেশাতে হবে। তারপর পরিমান মতো জল ঢেলে তাকে কোদাল দিয়ে ওলোট পালোট করে অর্ধ তরল লেই তৈরি করতে হবে। এখন গর্তের মধ্যেকার তরল কাদায় পুহা (চারার কটিং) গুলোকে ডুবিয়ে গোড়ার অংশ গোছধরে একটু কাত করে পুতে দিতে হবে।এই ভাবে পর পর গায়ে গায়ে কাটিং বসানোর সময় মাঝে মাঝে পাঁশ বা ছাই এবং বালি ছড়িয়ে দিতে হব।

কাটং বসানোর কাজ সম্পুর্ন হলে গর্তের বাকি অংশ মটি দিয়ে ভরাট করে দিতে হবে।

এই চারা তৈরির যায়গায় এক থেকে দেড় মাসের মধ্যেই চারা তৈরি হয়ে যায়, কাটিং থেকে নতুন পাতা গজাতে শুরু করে।এখন চারা তৈরি। মূল জমি তৈরি করে আখের কাটিং তুলে সেখানে বসিয়ে দিতে হবে। তাড়াতাড়ি চারা তৈরির প্রয়োজন হলে কটিংগুলি উপরোক্ত পদ্ধতিতে বসানোর পর উপরে ঝুরো মাটি দিয়ে তার উপর কাদার প্রলেপ দিয়ে দেওয়া যায়। আখ কেটে নেওয়ার পর মাঠে যে গোড়ার অংশ থাকে তাকে তুলে নিয়ে এসে তার শেকড় কেটে উপরোক্ত পদ্ধতিতে কাদা মাখিয়ে গর্তে মাটি চাপা দিয়ে রেখেও চারা তৈরি করা যায়।

এবার আসি মূল জমিকে তৈরি এবং সেই জমিতে আখের চার লাগানো বা বসানোর কথায়।

প্রথম যখন আখ চাষ শুরু হল তখন দু’চাষ দেওয়া জমিতে ১৮ ইঞ্চি চওড়া ৬থেকে ৮ ইঞ্চি গভীর লম্বা নালার মতো কাটা হয়। নালার দৈর্ঘ্য জমির আয়তন অনুযায়ী করা হয়।এমন একটি লাইনের পাশে ১৮ ইঞ্চি বাদ দিয়ে আবার একটি লম্বা একই রকম নালা কাটা হয়। এই যে দুটো লম্বাকৃতি নালা তৈরি করার সময় মাটি উঠলো সেই মাটি দুটো লাইনের মাঝখানের ফাঁকা অংশে রাখতে হবে।এই গোটা জমিতে লাইন তৈরি হয়ে গেলে এবার নালার ভেতরটা ৮ ইঞ্চি গভীর করে মাটি কুপিয়ে নিতে হবে। তার পর সেই মটিতে খত(পুরানো গোবর ও অন্যান্য কৃষি বর্জের মিশ্রন পচানো সার),নিম খোন(কীটনাশক হিসাবে) মিশিয়ে কয়েক দিন ফেলে রেখে দেওয়া হয়।তার পর নালায় জলসেচ দিয়ে কুপিয়ে কাদা তৈরি করে, সেই কাদার মধ্যে দু’লাইনে পর পর কাটিং গুলি শুইয়ে এক ইঞ্চি গভীরে পু্ঁতে দেওয়া হবে। তার পর ধীরে ধীরে চারা বড় হতে থাকে। মাঝে মাঝে আগাছা পরিষ্কার করতে নিড়ান দিতে হয়।কোদাল দিলে আগাছা দমনের পাশাপাশি মটি আলগা হয়।আখ গাছের কিছু শেকড় কাটা যায় ফলে আরো অনেক নতুন শেকড় গজায় এবং আখ গাছের গাছের বৃদ্ধি ভালো হয়।

তারপর জৈষ্ঠ্যমাসের মাঝামাঝির দিকে যখন আখ গাছের উচ্চতা প্রায় এক কোমর ছাড়িয়ে যায় এয়েক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে, এই সময় দুটো লাইনের মাঝের আল মতো অংশ কুপিয়ে মাটি দুই দিকে সরিয়ে দিলে আখ গাছের গোড়ার নিচু অংশ ভরাট হয়। তার কিছুদিন পরে বর্ষা নামার আগে আবার ঐ অংশের মাটি তুলে আখ গাছের গোড়া উঁচু করে দওয়া হয়। যাতে বর্ষায় গাছের গোড়ায় জল না দাঁড়ায়।আখ গাছের গোড়ায় জল দাঁড়ালে গাছের গোড়া আলগা হয়ে গেলে গাছ সোজা দাঁড়িয়ে থাকতে পারে শুয়ে পড়ে।এতে ফসলের ক্ষতি হয়।তাছাড়া আখেচ গাছ যত বাড়তে থাকে নিচের দিকের পাতাগুলো ভেঁগে গাছের সঙ্গে জড়িয়ে বেঁধে দেওয়া হয়।একে আখ জোড়া বলে।এই জোড়ার কাজ তিন থেকে পাঁচ বার কার হয়।প্রথমে তিন চারটা গাছ গোছা করে বাঁধা হয়। দ্বিতীয় বার আগের দুটো গোছাকে এক সঙ্গে করা হয়। তৃতীয় বার আরও উপরের দিকের পাতা ভেঙে উুঁচুতে তিন চারটে গোছকে এক সঙ্গে জোড় হয়।ফলে আখ গাছ লম্বা হলেও শুয়ে পর না।আখ চাষের এই সমস্ত কাজে নিপুন কর্মঠ মজুরের দরকার হয়।

কার্তিক অগ্রহায়ন মাসে ধান কাটা ঝাড়ার কাজ সেরে,পৌষের দ্বিতীয় সপ্তাহের মধ্যে আখ শাল তৈরীর তোড়জোড় শরু হয়।আখশাল হলো আখ ক্রেশারে মাড়িয়ে রস বের করে বড় উনুনে বসিয়ে তাপ দিয়ে গুড় রান্না করার যায়গা।

প্রথমের দিকে রাসায়নিক সারের প্রয়োগ খুব একটা না হলেও দ্রুত ব্যবস্থার আমুল পরিবর্তন ঘটে। ক্রমশ এই ফসল বানিজ্যিক ফসলে পরিনত হয়। পরবর্তী কালে রাসায়নিক সার কীটনাশকের এর ব্যবহার ব্যপক হারে বেড়ে যায়। আখ লাগান থেকে শুরু করে গুড় তৈরির ব্যবস্থায় নানা পরিবর্তন আসে সে বিষয়ে পরের পর্বে লিখবো।

কৃষিকাজ 1

—————————————————————————————————————

৬ষ্ট পর্ব

১৯৭৫ সাল নাগাদ আখের চাষ হতো। আখ মেশিনে পিষিয়ে রস বের করা এবং সেই রস বড় উনুনে বসিয়ে জাল দিয়ে গুড় তৈরির এই পুরো প্রকৃয়া সারা শীতকাল জুড়ে হতো। মগশুর মাসে ধান কাটা ও ধান ঝাড়ার কাজ শেষ কর আখ কাটার তোড়ঝোড় শুরু হয়। আখ কাটা শুরুর আগে মেলাই কাজ। প্রথম কাজ আখ মাড়াই মেশিন বসানো। সেই সময় আখ মাড়াই কল গরুতে টানতো। এই কল সাধরনত মাঠেই বসানো হত। একটা চৌকো চার ফুট বাই চার ফুট গর্তের মধ্যে এই কলটি বসাতে হতো। গর্তের মধ্যে এক জন কোনো রকমে বসে লম্বা লম্বা আখ মেশিনে ধরিয়ে দিতো। মেশিনের মাথায় একটা মোটা এবং লম্বা ডান্ডার এক প্রান্ত লাগানো থাকতো। অপর প্রান্তে এক জোড়া গরু যোতা হতো। এক জন লোক গরু দুটোকে তাড়া করলে তারা গোল হয়ে ঘুরতো। আখ নিংড়ে কলের সামনের দিক দিয়ে রস বেরিয়ে আসে এবং পেছনের দিক দিয়ে ছোবড়া বেরিয়ে যায়। এই চার ফুট বাই চার ফুট গর্তের মধ্যে কলের সামনে একটা গর্ত থাকতো,যার মধ্যে পাশাপাশি দুটো পনেরো কেজির তেলের টিন বসানো যেতো। এর মধ্যে রস গড়িয়ে পড়তো।আখ পেশাই মেশিন কে “শাল” বলতো,আবার মেশিন ও গুড় রান্নার বড় উনুন,উনুনের উপর যে চালা ঘরে রয়েছে এই সবটাকে বলা হতো শাল ঘর।

যে কথা বলছিলাম। আখ যখন বানিজ্যিক ফসল ছিল না তখন রসে তাপ দেওয়ার শুরু থেকে গুড়ে পরিনত হওয়া পর্যন্ত একজন বিশেষজ্ঞ লোক ছাঞ্চা, ডাবু নিয়ে ডেগের (রস জাল দেওয়ার বড় কড়া) সামনে বসে থেকে গাদ ছেঁকে তোলার কাজ খুব যত্ন সহকারে করতেন। এই বিশেষজ্ঞ কে বল হতো গুরিয়া। গুড়িয়ার মজুরি অন্য কৃষি শ্রমিকদের থেকে বেশি।গুড়িয়া গুড় তৈরি করা ছাড়া অন্য কোন কাজ করতো না। পরবর্তীকালে এই চাষ যখন বাড়তে শুরু করল সবাই গুড় তৈরি করত লাগলো,গুড়য়া পদের মর্যাদা কমতে লাগলো। কমতে লাগলো গুড়ের গুনমানও । বানিজ্যিক ভাবে আখ চাষের প্রয়োজনে আখের রস বের করতে গরুর পরিবর্তে ৮-১০ অশ্ব শক্তির মেশিনের ব্যবহার হলো। জমিতে চাষ দেওয়ার জন্য গরুতে টানা লাঙ্গলের পরিবর্তে ট্রাকটরের ব্যবহার হতে লাগলো। রাসায়নিক সারের যথেচ্ছ ব্যবহার হতে থাকলো।

—————————————————————————————————————

৭ম পর্ব

আমার বয়স যখন সাত বছর, সালটা১৯৭৩। চাষের কাজে ইউরিয়া সারের ব্যবহার শুরু হয়ে গেছে। যথেষ্ট পরিমান গোবরসার ব্যবহার হতো, সঙ্গে খুব কম মাত্রায় রাসায়নিক(ইউরিয়া), বিশেষত সবজি চাষে ব্যবহৃত হতো। তারপর আউশ ধানে থোড় আসার আগে বিঘা প্রতি ( ছেচল্লিশ শতক )দেড় কেজি ইউরিয়া দেওয়া হতো। ধীরে ধীরে ইউরিয়ার প্রয়োগ সব চাষের ক্ষেত্রে বাড়তে থাকে। সব আমন ধানই দেশীয়। উচ্চ ফলনশীল বেঁটে জাতের ধান চাষ তখনো শুরু হয়নি। আমন ধান দুই পদ্ধতিতে চাষ করা হতো।

১ম পদ্ধতি বোনা ধান। মাঘ ফাল্গুন মাসে বৃষ্টি হলে আমন ধানের জমিতে চাষ দেওয়া শুরু হয়।এক চাষ দিয়ে ফেলে রাখা হলো। তার পর চৈত্রের শেষে বা বৈশাখের শুরুতে একটু ভারী বৃষ্টি হলে তারপর মাটিতে বতর(জো) ঠিকঠাক হলে ২য় চাষ দিয়ে ধান বুনে দেওয়া হয়। ধান বুনে আর একচাষ দিয়ে মই দিলেই বোনার কাজ শেষ। তারপর আর কোন কাজ নেই।জৈষ্ঠ্যমাসের শেষ সপ্তাহ থেকে আষাঢ় মাসের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে আমন ধান জমিতে গরু ছেড়ে ধান গাছ খাওয়ানো হতো।এই কাজটিকে বুয়ালী খাওয়ানো বলা হতো। তারপর ভালো করে বৃষ্টি নামলে জমিতে যখন জল দাঁড়িয়ে যায়,তাকে জল লাগা বলতো। মাঠে জল লাগলে মাটি নরম হয়ে যেতো,তখন আমন ধান বোনা জমিতে প্রথমে মই দিয়ে তার পর লাঙ্গল দেওয়া হতো। একে কাড়হান দেওয়া বলতো। এই কাড়হান দেওয়ার দু-তিন দিনের মধ্যে চালান দেওয়া হতো। এখানে চালান দেওয়া মানে হলো লাঙ্গল দেওয়ার ফলে যে ধান গাছ গুলো চাপা পড়ে গেছে বা কাত হয়ে গেছে সেগুলোকে সমান দূরত্বে সোজা করে সাজিয়ে দেওয়া এবং ঘাসগুলোকে পা দিয়ে মাড়য়ে বা হাত দিয়ে কাদার মধ্যে পুঁতে দেওয়া। বোনা ধানের ক্ষেত্রে কাড়হান, চালান শেষ মানে কাজ প্রায় শেষ। এই কাজ শ্রাবণ মাসের মধ্যেই শেষ করতে পারলে ভালো। তারপর মাস খানিক পরে একবার নিড়ান দেওয়া।নিড়ান দেওয়া পর অল্প পরিমানে ইউরিয়া সার দেওয়ার চল ছিল।

২য় পদ্বতি রোয়া করা। এই পদ্ধতিতে প্রথমে বীজতলা তৈরি করতে হয়। তার পর বীজতলায় চারা তৈরি হয়ে গেলে মূল জমিতে চাষ দিয়ে, কাদা করে, তাতে বীজতলা থেকে চারা তুলে এনে, মূল জমিতে রোপন বা রোয়া করা হয়। আমন ধানের বীজ তলা আবার দুভাবে করা যায়।এক শুকনো বীজ তলা। দুই কাদা তৈরি করে তার উপর ধান বীজ ছড়ানো।এই দ্বিতীয় পদ্ধতিই বহুল প্রচলিত তাই এই পদ্ধতির বিস্তারিত বিবরণ দিচ্ছি না।

তারপর ধীরে ধীরে বোরো ধান চাষ শুরু হয়। সালটা ঠিক মনে নেই কিন্তু যখন প্রথম বোরো ধান চাষ শুরু তখন নদী, খাল ইত্যাদির ধারে যেখানে জলের প্রাকৃতিক উৎস রয়েছে সেখানে এই চাষ হতো। আর সেই সমস্ত জমিতে বোরো চাষ হতো যে জমিতে বর্ষায় অতিরিক্ত জল জমার কারণে আমন ধান চাষ করা যেত না। একে কোথাও খরাটি চাষ বলা হয়।এর আর এক নাম বিকল্প চাষ।পরবর্তী কালে এই বিকল্প চাষের জমি বহুদূর প্রসারিত হয়েছে।প্রতিস্থাপিত হয়েছে অন্যান্য অনেক ফসল যেগুলো চাষ করতে ধান চাষের প্রয়োজনীয় জলের দশ শতাংশ হলেই চাষ হয়ে যায়। ফলে যথেচ্ছ মাটির তলার জল উত্তোলন হতে থাকলো। ধান চাষে এখন বীজ তলা থেকে শুরু করে জমি তৈরি প্রতি স্তরে যথেচ্ছ রাসায়নিক সার ও বিষ প্রয়োগ হচ্ছে। বাস্তুতন্ত্রের দফারফা করে আমরা আমাদের কবরের মাপ বড় করছি। বাস্তুতন্ত্রের কি ক্ষতি হচ্ছে? জমিতে রাসায়নিক সার বিষ প্রয়োগের ফলে জমির কেঁচো,ব্যাঙ,বিলের চুনো মাছ,গেঁড়ি-গুগলি সবই হারাতে বসেছে।গ্রাম বাংলার নদী-নালায় পর্যন্ত এই বিষের প্রভাব পড়ছে।

এখনকার চাষ ব্যবস্থা এবং তার কুফল সম্পর্কে এই অনুভূতি, আমার, কিছু পরিবেশ সচেতন শিক্ষিত মানুষ , হাতে গোনা কয়েক জন কৃষি বিজ্ঞানী ও পরিবেশ বিজ্ঞানীর। আমার ধারনা দেশের আপামর কৃষকের কিন্তু এই অনুভূতি নয়।কারন সরকারী কৃষি দপ্তর এবং এদের স্বপক্ষে প্রচারিত নানা রকম মিথ্যা বিজ্ঞাপন। তার জন্য কৃষকরা দায়ী নয়। তার জন্য দায়ী রাষ্ট্র, রাষ্ট্রের কৃষি পরিকল্পনা,বহুজাতিক পু্ঁজিপতিদের স্বার্থে তৈরি সরকারী কৃষি নীতি

—————————————————————————————————————

পর্ব-৮ম

★কচু আর কাঁচকলা★

সবুজ বিপ্লবের কথাটা আগে শুনলেও জৈব কৃষি শব্দবন্ধটির সঙ্গে পরিচয় ঘটে ২০০৮ সাল নাগাদ। তখন আমার বয়স ৪৩ বছর। অথচ ১৯৯২-৯৩ সাল মানে ২৬-২৭ বছর বয়স পর্যন্ত প্রচলিত বর্তমান কৃষি ব্যবস্থার সঙ্গে প্রত্যক্ষ ভাবে যুক্ত থেকেও এ সম্পর্কে কোনো সংশয় তৈরি হয়নি। আমাদের দেশে সবুজ বিপ্লব মার্কিন পুঁজিপতিদের স্বার্থে ফোর্ড ফাউন্ডেশনের শর্তে স্বামীনাথনের নেতৃত্বে ঘটে। তার প্রায়োগিক কর্মসূচি হিসাবে তৈরি হলো কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। সেই সব প্রতিষ্ঠান থেকে পাশ করা কৃষি বিজ্ঞানীদের প্রধান ও প্রথম কাজ হলো সারা দেশের কৃষকদের পুরুষানুক্রমে অর্জিত কৃষিজ্ঞানকে অস্বীকার করা। তাদের সুবিপুল বিচিত্র বীজ ভান্ডারকে হেয় করে তাকে ধ্বংস করা। যা কয়েক দশকের প্রচেষ্টায় আজ দেশের কৃষি সংস্কৃতিকে ধ্বংস করতে সক্ষম হয়েছে। আজকের কৃষক বীজ সংরক্ষণের শিক্ষা ও উত্তরাধিকার হারিয়ে ফেলেছে।

সবুজ বিপ্লবের সুফল নিয়ে সরকারি ঢক্কানিনাদ জনমানসে এমন প্রভাব ফেলেছে যে, এ কথা বলতে গেলে শহরের শিক্ষিত- মধ্যবিত্ত মানুষ যার কৃষি সম্পর্কিত প্রত্যক্ষ জ্ঞান শূন্য সে ও ” রে রে ” করে ওঠে। সবুজ বিপ্লব না হলে দেশের মানুষ খেতে পেতো না বলে। এমনকি কৃষকরাও এই প্রচারে প্রভাবিত।

অথচ একটু তলিয়ে দেখলে বোঝা যায়,

ক) চাষযোগ্য জোতজমির আয়তন বৃদ্ধি,

খ) সেচ ব্যবস্থার বিকাশ, ফল স্বরূপ এক ফসলি জমির দুই বা তিন ফসলি জমিতে পরিনত হওয়া।

গ) কৃষিক্ষেত্রে প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি।

ঘ)রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার

ঙ)উচ্চ ফলনশীল ও সংকর বীজ ব্যবহার।

সবকিছুর যোগফলকে সবুজ বিপ্লবের সুফল হিসাবে দেখানো হচ্ছে। বলা হচ্ছে ১)দেশীয় বীজের পরিবর্তে উচ্চ ফলনশীল ও সংকর বীজ ব্যবহার।

২) সার – কীটনাশক ব্যবহার করেই যেন এই সাফল্য এসেছে।

যেকথা বলছিলাম, প্রথম যখন

জৈব কৃষির কথা শুনে আমার মনে খুব সংশয় দেখা দিয়েছিল। মনে হয়েছিল, সার না দিলে ভালো ফসল হবে কিভাবে? দুই, ঔষধ( বিষ বা কীটনাশক বললেও মনে করতাম ঔষধ) না দিলে চাষ হবে ? সংশয় কাটাতে আনুপম পাল মহাশয়ের অনেক বক্তব্য, তাঁর লেখা বই “কৃষিঃ ভাবনা ও দুর্ভাবনা ” খুব সাহায্য করেছে। অভ্র চক্রবর্তীর সাহায্যে পেয়েছি। ডি আর সি এস সির সহযোগিতা পেয়েছি। ইরিম এই সুযোগ করে দিয়েছিল। এতৎসত্ত্বেও সংশয় কেটেছে নিজে হাতে কাজ করে। মূলকথা বুঝেছি যে, শত্রু পোকা দমন করতে গিয়ে যদি বিষ প্রয়োগ করি তাতে শত্রু পোকার পাশাপাশি বন্ধু পোকারাও মরবে, মরবে মাটিতে মিশে থাকা আরও অনেক অণুজীব। এর ফলে প্রাকৃতিক খাদ্য শৃংখল ছিন্ন হবে। ৷ আচ্ছা, যখন রাসায়নিক সার ও বিষের প্রচলন ছিল না তখন কীভাবে চাষ হতো? পোকার উপদ্রব যাতে না হয় তার জন্য কী কিছু ব্যবস্থা নিতেন? বা হলে কি করতেন? এই নিয়ে পরের পর্বে লিখবো।

ইন্ডিয়ান রিসার্চ ইনস্টিটিউট অফ ইন্টিগ্রেটেড মেডিসিন এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে জৈব কৃষি নিয়ে কাজ শুরু করেছি। একদিকে এই বিষয়ক কর্মশালায় অংশ গ্রহণ করছি,জৈব কৃষি বিষয়ক বই পড়ছি,নিজে একটি টুকরো জমিতে হাতে-কলমে কাজ করছি আবার আমতা এলাকায় চাষিদের সঙ্গে মিটিং করছি জৈব চাষ করার প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে।

আমাদের গ্রামে চাষ হওয়া কিছু কিছু ফসলে কখনো কোনো রাসায়নিক সার বা কীটনাশক প্রয়োগ হতে দেখিনি। সেগুলোর মধ্যে একটি কচু চাষ। সাধারণত বাস্তুর আশপাশে উঁচু জমিতে,একটু ছায়াযুক্ত হলেও অসুবিধে নেই,কচু ওল লাগানো হয়। খামালুও ঘর লাগোয়া বাগানে বড় গাছের গোড়ায় বড় গর্তকরে, সেই গর্তের মধ্যে গোবর সার, পাতাপচা সার ছাই ইত্যাদি দিয়ে গর্ত ভরাট করে তার মধ্যে লাগানো হতো। চৈত্র মাসের শেষ সপ্তাহে বা বৈশাখের শুরুতে কচু লাগানো হতো। জমিতে গোবর সার, পাতাপচা সার, গোয়ালের ঝাঁট দেওয়া আবর্জনা,গৃহস্থের উনুনের ছাই দিয়ে ঝুরঝুরে করে মাটি তৈরি করে কচু লাগাতে হয়। সেই কচু তোলা হয়

শীতকালে যখন গাছ মরে যায় তখন। এই কচু চাষে কখনো বিষ দিতে লাগে না। আবার আমি হাওড়ার আমতায় শীতের শেষে আলু তোলার পর ঐ জমিতে কচু চাষ করতে দেখেছি। চাষিদের সঙ্গে কথাবলে জেনেছি তারা বেশ ভালো পরিমানে কীটনাশকের প্রয়োগ করে।তারা বলে তেল (কীটনাশক) ছাড়া কচু চাষ অসম্ভব। তেল না দিলে নাকি এক ধরনের পোকা সব কচু গাছ খেয়ে নেব।

এবার আসি ওলের কথায়। ছোট বেলায় আমাদের প্রায় বাড়িতে ওল লাগানো হতো। কোন বড় জমি জুড়ে ওল লাগানো হতো না। পগারে (বেড়ার ধারে),পুকুর পাড়ে ওল লাগানো হত। মদন কাকার ওল ছিল খুব নাম ডাক।

সে ওল দেশী ওল।সেই ওল চাষে সার বিষ প্রয়োগের বালাই ছিল না। এখন বাজারে যে ওল পাওয়া যায় তাকে ম্যাড্রাসি ওল কেন বলে জানি না।এই ওল চাষে রাসায়নিক সার ও বিষ ভালো পরিমাণে ব্যবহৃত হচ্ছে।

কলা চাষ সম্পর্কে খনার বচনে –

১)সাত হাত তিন বিঘতে

কলা লাগাবে মায়ে পোয়ে,

২) লাগিয়ে কলা না কাট পাত

তাতেই কাপড় তাতেই ভাত।

কলা চাষ যতদুর জানি,হুগলি, বর্ধমান, উত্তর ২৪ পরগণা, নদীয়া, মুর্শিদাবাদে অর্থকরী ফসল হিসেবে চাষ করা হয়। সেক্ষেত্রে আগে কতটা রাসায়নিক সার বা কীটনাশক, বা এখন কতটা কি ব্যবহার হয় আমার জানা নেই। ঝাড়গ্রাম, দুই মেদিনীপুর বা রাজ্যের অন্যান্য জেলাগুলিতে অনেকের বাড়িতে যে কলা লাগানো হয় তাতে সার বিষের ব্যবহার প্রায় হয় না বললেই চলে। পেঁপে চাষের ক্ষেত্রে ও প্রায় একই অবস্থা ।

প্রশ্ন হতে পারে এই আধো আধো জানাবোঝা নিয়ে এই লেখা কেন? আসলে আজকের দিনে স্বাস্থ্য সচেতন মানুষ বিষহীন খাবার খুঁজে থাকেন,কিন্তু তাঁদের বেশির ভাগ খাবার উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত নয়,আর যারা উৎপাদক তাঁরা এ বিষয়ে সচেতন নন।এমতাবস্থায় কী করণীয় তাতে আমার এই লেখা কিঞ্চিৎ সাহায্য করতে পারে।

এক্ষেত্রে আশপাশের উৎপন্ন শাক,সবজি,ফলপাকুড় খোঁজা; যে ফসল যে সিজনের তা খাওয়া; অসময়ের জিনিস না খাওয়া এবং ছোটো উৎপাদকের জিনিস কেনা। পারলে বসত বাড়ির কাছে বা বাড়ির ছাদকে ব্যবহার করে যা যতটা পারা যায় উৎপাদন করা।

নিজে উৎপাদন করলে,তা সে যত কমই হোক, কৃষকদের শ্রমের গুরুত্ব কিঞ্চিৎ উপলব্ধি করা যায়।

1 Comment

  • You are supporting traditional process of agriculture. This is the best process. Proper application of this traditional process will help to success of zero hunger and food for all program of United Nations.

Leave a Comment