প্রতিবেদন

সাইকেল এবং জলবায়ু পরিবর্তন

সাইকেল এবং জলবায়ু পরিবর্তন

ভাবছেন এও কিভাবে সম্ভব? জলবায়ু পরিবর্তনের মত একটা ভীষণ কঠিন বিষয়ের সমাধান কতটা হতে পারে বাইসাইকেল? জুন মাসের ৩ তারিখে, বিশ্ব সাইকেল দিবস উপলক্ষে সেই সন্ধান করল সবুজ পৃথিবী। বিশ্ব সাইকেল দিবসে এই অসাধারণ ছবিটি এঁকেছেন স্বপ্নালি খামারু।

ট্রান্সপোর্ট সেক্টর থেকে পৃথিবীর মোট গ্রিন হাউস গ্যাসের নির্গমনের প্রায় ১৫ শতাংশের কাছাকাছি বেরোয়। আমাদের দৈনন্দিন যাতায়াতের একটা ছোট্ট অংশ সামান্য পরিবর্তন করলে আমরা জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে নিঃসন্দেহে যুদ্ধ ঘোষণা করতে পারি। সম্প্রতি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিশ্চিয়ান ব্র্যান্ডের নেতৃত্বে পৃথিবীর সাতটি শহর জুড়ে প্রায় 4 হাজার মানুষের উপরে করা একটি গবেষণা থেকে জানা গেছে যদি আমরা আমাদের দৈনন্দিন যাতায়াতের একটি মাত্র ট্রিপ গাড়ি ব্যবহার না করে সাইকেল ব্যবহার করি, সে ক্ষেত্রে প্রতিটি নাগরিকের ট্রান্সপোর্ট সেক্টরে গ্রীন হাউজ গ্যাসের এমিশন প্রায় ৬৭ শতাংশ কমানো যেতে পারে।

এই সমীক্ষাতে আরও জানা গেছে যদি জনসংখ্যার মাত্র 10 ভাগ মানুষ দিনে একটি করে ট্রিপ গাড়ির বদলে বাইসাইকেলে করেন, সে ক্ষেত্রে ট্রান্সপোর্ট সেক্টরের গ্রিনহাউস গ্যাসের পরিমাণ প্রায় ১০ শতাংশ কমে যাবে। এই সমীক্ষায় একটি চমক জাগানো তথ্য হলো আমরা কাজের থেকে অকাজে (বাজার করা বা ঘুরতে যাওয়া) গাড়ি বেশি ব্যবহার করি। অর্থাৎ যেখানে হাতে সময় নিয়ে বেরোলে অনায়াসে হেঁটে বা গণপরিবহনে বা সাইকেলে যাতায়াত করা সম্ভব, সেই সমস্ত জায়গায় আমরা প্রতিনিয়ত গাড়ির ব্যবহার করে আসছি। কাজের ক্ষেত্রে সময়ানুবর্তিতার কারণে যদি আমরা গাড়ি ব্যবহার করি ও, বাকি ক্ষেত্রবিশেষে সাইকেল ব্যবহারে আমাদের ব্যক্তিগত গ্রীন হাউজ গ্যাস নির্গমন এর পরিমান প্রভূত পরিমাণ কমিয়ে আনতে পারি।

সম্প্রতি জলবায়ু পরিবর্তনের সবথেকে বৃহত্তম এবং নির্ভরযোগ্য সংস্থা আইপিসিসি তার রিপোর্টে পরিষ্কার করে দিয়েছে যে সরকারি পলিসি যেরকম জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়তে সাহায্য করতে পারে, একইভাবে প্রতিটি ব্যক্তিকে তার জীবনযাত্রার পরিবর্তনের মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। সেই পরিবর্তন গুলির অন্যতম হল স্বল্প দূরত্বের যাতায়াত হেঁটে বা সাইকেলে করা।

আমাদের শহরগুলিতে এরকম অসংখ্য রাস্তা আছে যেখানে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে গাড়িতে করে ৩০ মিনিট লাগে আর হেঁটে লাগে ১০ মিনিট। সময়ের সাথে সাথে গাড়ির সংখ্যা বাড়ছে হু হু করে এবং তার সাথে বাড়ছে ট্রাফিক জ্যাম এর পরিমান। সম্প্রতি ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের একটি পলিসি রিসার্চ পেপার অনুযায়ী কলকাতা, বেঙ্গালুরু এবং হায়দ্রাবাদ ভারতবর্ষের মধ্যে সবথেকে ধীরগতিসম্পন্ন শহর। শহরে আলাদা সাইকেল লেন থাকলে যেরকম রাস্তায় গাড়ির পরিমাণ কমবে তেমনি শহরের গতিও বৃদ্ধি হবে। বিশেষত ছোট ছোট ট্রিপ গুলোর ক্ষেত্রে অনেক সময়ই, গাড়ি ব্যবহার করলে অনেক বেশী সময় লাগে। একটা উদাহরন দিলে বোঝা যাবে, আপনি হয়তো ১০ মিনিট দূরের একটা জায়গায় যাবেন, এবং সেইজন্যে অ্যাপের সাহায্যে যে গাড়িটি আপনি বুক করলেন তা আরো ১৫ মিনিট ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে জ্যাম বাড়াতে বাড়াতে আপনার কাছে পৌঁছলো! অর্থাৎ, এক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে আপনিও জ্যাম বাড়াচ্ছেন। আবার অনেক সময় নিজের গাড়ি থাকলে, আমরা পাঁচ পা দূরের দোকানে ও গাড়িতে করে যেতে পছন্দ করি। সে ক্ষেত্রে আপনি সরাসরি জ্যাম এবং গ্রীন হাউজ গ্যাস বাড়াচ্ছেন।

কাজেই আমরা যদি একটু গাড়ি ছেড়ে সাইকেলের দিকে মন দি, তাহলে ট্রাফিক জ্যামের পাশাপাশি কমবে গ্রীন হাউজ গ্যাস ও। উপরন্তু জলবায়ু পরিবর্তন এবং আমাদের জীবনযাত্রার পরিবর্তনের কারণে একাধিক নতুন নতুন রোগের উৎপাত বাড়ছে। সাইকেল চালানো কিন্তু একটা দারুণ ভাল এক্সারসাইজ ও। সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি শহরে স্বাস্থ্য সম্পর্কিত একটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা গেছে দিনে মাত্র আধঘন্টা সাইকেল চালালে ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ৪০ হাজার টাকার কাছাকাছি বছরে শুধুমাত্র স্বাস্থ্য খাতে কম খরচা হয়। ভারত বর্ষ বা বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই সংখ্যাটা হয়তো এতটা বেশি নয়, কিন্তু সেটা কম হলেও যে ফেলে দেওয়ার মতো নয় তা বলাই বাহুল্য। এই প্রসঙ্গে আরেকটি বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান এর কথা বলা জরুরী। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের 11 টি শহরের উপরে একটি সমীক্ষা চালিয়ে দেখা গেছে, যদি প্রতিটি মানুষ তার যাতায়াতের একপিঠ গাড়ির বদলে বাই সাইকেলে করে যায়, সে ক্ষেত্রে এই শহরগুলি শুধুমাত্র স্বাস্থ্য খাতে ৭.৩ বিলিয়ন ইউএস ডলার বাঁচাবে তাই নয়, উপরন্তু প্রায় এগারো শো মানুষের প্রাণ প্রতি বছর বাঁচবে।

কাজেই সাইকেল চালান। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে সাইকেল চালান। শহরের গতি বাড়াতে সাইকেল চালান। কিছু না হোক, অন্তত ভীষণ স্বার্থপর হয়ে শুধুমাত্র নিজের শরীর এবং টাকা বাঁচাবার জন্য সাইকেল চালান।

Leave a Comment