“Give a man a fish and you feed him for a day; teach a man to fish and you feed him for a lifetime.” অর্থাৎ একজন মানুষকে একটি মাছ দিলে সে একদিন খেতে পারে কিন্তু একজন মানুষকে কি ভাবে মাছ ধরতে হয় শিখিয়ে দিলে সে সারা জীবন খেতে পারে।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে যে কয়েকটি শব্দবন্ধ জনপ্রিয় হয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হলো সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট বা সুস্থায়ী উন্নয়ন। কি এই সুস্থায়ী উন্নয়ন সেটা বোঝাতে গেলে অষ্টাদশ শতাব্দীর এই বিখ্যাত উক্তিটিই যথেষ্ট। আর এই বিষয়টিকে হাতে কলমে করে দেখাচ্ছে যারা তার মধ্যে অন্যতম হল মৈত্রেয়।
পুরুলিয়া, রাঢ় বাংলার এই জেলাটির রুক্ষ শুষ্ক জলবায়ু, অনুর্বর লাল মাটি, জলের অপ্রতুলতার জন্যে আয়েশি জীবনযাত্রার অন্তরায়। বিরহড়রা এই অঞ্চলের এক আদিম অরণ্য নির্ভর উপজাতি যারা মূলত জঙ্গলের কাঠ, ছাতু, গাছের ছাল এবং অন্যান্য জিনিস থেকে জীবন যাত্রা নির্বাহ করত। সকালে উঠে জঙ্গলে যাওয়া এবং সংগ্রহ করে আনা বিভিন্ন উপাদান হাটে বিক্রি করে কোনো ক্রমে সংসার চালানো বিরহড়দের মধ্যে অপুষ্টি জনিত রোগের হার সাংঘাতিক বেশি। ২০১৮ সালে মৈত্রেয় সপ্তর্ষি যখন নিতান্ত কৌতূহলের বসে এখানে বেরসা গ্রামে আসে, তখন সে দেখে ভাতের মাড়, পিপড়ের ডিমের ওপর ভরসা করে কি করে একটা আস্ত গ্রাম চলছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে!
সাধারণভাবে এর পরে শুরু হয় ফেইসবুকে পোস্ট, আলুথালু পোশাকের বাচ্চাদের ছবি, ত্রাণের জন্যে অনুরোধ এবং অল্প চাল, ডাল, তেল, সাবান বিতরন করে ছবি তোলার হিড়িক! কি হবে তাতে? একমাস চলবে এদের, তার পর সবাই যে যার বাড়ি ফিরে যাবে আর আবার বিরহড় গ্রাম বেড়সা ভাতের মাড় আর পিপড়ের ডিম খেয়ে কাটাবে।
মৈত্রেয় কিন্তু এভাবে ভাবে নি। প্রচলিত নাম কেনা মডেলের সম্পূর্ণ উল্টোপথে হেঁটে সুস্থায়ী উন্নয়নের একটা দৃষ্টান্ত একা হাতে তৈরি করেছে। প্রথমে বাড়ি বাড়ি ঘুরে সার্ভে করে অর্থনৈতিক অবস্থা, স্বাস্থ্য, পুষ্টি এবং সরকারি কার্ড আছে কিনা সেই নিয়ে পরিবার পিছু ডেটাবেস তৈরি করেছে। বিরহড় গ্রাম বেড়সার প্রতিটি মানুষের সাথে মিশেছে, কথা বলেছে এবং তাদের সুখ দুঃখের সাথে মিশে যাওয়ার চেষ্টা করেছে। এরপর, তারা সমস্ত সরকারি অফিসে গেছে এবং প্রশ্ন করেছে। কেন নলকূপ নেই, কেন কাজের কার্ড নেই, কেন কার্ড থাকলেও কাজ নেই, কেন পয়সা কম দেওয়া হচ্ছে, কেন টিকাকরণ হয় না! দিন মাস বছর ঘুরে, মৈত্রেয় আরো কিছু মানুষকে পাশে পেয়েছে। সরকারি দপ্তরের মানুষেরা মৈত্রেয়কে চিনেছে আর বিরহড় গ্রাম বেড়সার মানুষেরা তাদের সত্যি কারের বন্ধুকে পেয়েছে।
সরকারি সমস্ত কিছু স্কিম পাওয়ার পর আসল লড়াই শুরু হল। সেটা হল জীবিকার লড়াই। বলা ভালো জীবিকা তৈরি করার লড়াই। মাটি অনুর্বর তাই কৃষি পরামর্শদাতাদের কাছে ছুটে গেছে মৈত্রেয়। মাটির উপাদানের পরীক্ষা নিরীক্ষা করে কি ফসল ফলানো হবে সেই বিষয়ে সিধু কানহু বিশ্ববিদ্যালয় সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। উত্তরবঙ্গের বিখ্যাত জৈব কৃষি সংস্থা ফিয়াম, বীজ এবং জৈব চাষের পদ্ধতি হাতে কলমে শেখাচ্ছে বিরহড়দের। যেহেতু এরা অরণ্য নির্ভর উপজাতি তাই চাষ করানো শেখানো হচ্ছে এদের। সাথে সাথে মাছ চাষ থেকে পশুপালন – ট্রেনিং দেওয়া হচ্ছে সব কিছুর। স্থানীয় ফল থেকে আচার তৈরি করা হচ্ছে এবং বিক্রি করে সেই টাকা জমা করা হচ্ছে পরিবারের ব্যাংক একাউন্টে। সরকারের দেওয়া পাট্টা জমিতে যৌথভাবে চাষ করা হচ্ছে। সাথে সাথে বাচ্চাদের জন্যে একটা স্কুল শুরু করা হয়েছে সেখানে স্থানীয় একজন কৃষক বাচ্চাদের পড়াচ্ছেন। সৌর বিদ্যুৎ এবং জল সঞ্চয়ী ব্যবস্থা শুরু করা হয়েছে।
মৈত্রেয় চাইলেই দুদিন থেকে কিছু ত্রাণ দিয়ে ফেসবুক ভরিয়ে দিয়ে আসতে পারত। কিন্তু তার বদলে তারা যেটা করেছে সেটা রাষ্ট্রপুঞ্জের ভাষায় বলা যায় নলেজ বেস লাইভলিহুড প্রমোটিং এন্ড সাসটেইনেবল ইন্তেন্সিফিকেশন অফ ন্যাচারাল রিসোর্স। অর্থাৎ মানুষের কাছে জ্ঞান পৌছে দেওয়া, এবং সেই জ্ঞান তাদের জীবিকা নির্বাহ করতে সাহায্য করার মত জ্ঞান।
ত্রাণ কেন্দ্রিক অর্থনীতি কখনই সুস্থায়ী এবং দীর্ঘমেয়াদী সমাধান হতে পারে না। জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে। আমরা আরো বেশি বেশি করে সাইক্লোনের মুখে পড়বো, বন্যা বাড়বে, বাড়বে খরা ও। বর্ষায় বৃষ্টিপাতের তারতম্য হবে প্রতি বছর। কিন্তু সেসব নিয়েই আমাদের বেঁচে থাকার লড়াই করে যেতে হবে। সেই বেঁচে থাকার লড়াইয়ে ত্রাণ সাহায্য করবে না, সাহায্য করবে জ্ঞান। এককালীন অর্থ সাহায্য করে মানুষকে ক্ষনিকের স্বস্তি না দিয়ে, মৈত্রেয় জীবন জীবিকার আরোহণের সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে পুরুলিয়ার এই গ্রামে। তারা মানুষের কাছ থেকে কোনো রকমের আর্থিক সাহায্য নেয় নি বা দেয়নি। সরকারের সাথে কথা বলে মানুষকে মানুষের প্রাপ্য পেতে সাহায্য করেছে। এবং বিশেষজ্ঞদের সাথে কথা বলে এখানের মানুষের জন্য জীবন-জীবিকার সুযোগ এনে দিয়েছে। সরাসরি বাজারজাত করেছে পণ্য। ব্যাংক একাউন্ট খোলার ফলে আরো ট্রান্সপারেন্ট হয়েছে টাকার আদান-প্রদান।
রাষ্ট্রপুঞ্জ এবং বিশেষজ্ঞরা বর্তমানে জ্ঞানভিত্তিক এবং তথ্যভিত্তিক দারিদ্র্য দূরীকরণের কথা বলছেন। যেখানে মানুষকে সরাসরি অর্থসাহায্য না করে তার জীবন জীবিকা তৈরি করে দেওয়ার মাধ্যমে তার আর্থসামাজিক উন্নয়ন করা হবে। মৈত্রেয় বইয়ে পড়া জ্ঞানের বাইরে গিয়ে হাতে-কলমে এই জিনিসটি করে দেখিয়েছে।
আপনারা যদি মৈত্রেয় কে সাহায্য করতে চান তাহলে দয়া করে টাকা দিয়ে সাহায্য করবেন না। বরং এখানে বিকল্প জীবন-জীবিকার সম্পর্কে ওয়ার্কশপ করাতে সাহায্য করুন, এখানের মানুষকে শেখান আর কি কি উপায় তারা তাদের জীবন-জীবিকা অর্জন করতে পারে। বা স্কুলে এসে পড়িয়ে যান বাচ্চাদের। এককালীন কিছু করার কথা ভাববেন না, কারণ সেটা দীর্ঘমেয়াদী হবে না। পরিশেষে বলি মৈত্রেয়ের সদস্যরা বিভিন্ন কাজে পূর্ণ সময়ের জন্য নিযুক্ত কিন্তু তারা দেড়শ দুশো কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে নিয়মিত এই গ্রামে আসে এবং মানুষের সাথে কাজ করে। যদি সত্যিই উন্নয়ন করতে চান, তাহলে প্রথমে সমস্যা কি তা বোঝার চেষ্টা করুন। জোর করে সমাধান চাপিয়ে দেবেন না। বিশ্বাস অর্জন করুন, বিশেষজ্ঞদের সাথে কথা বলুন। সরকারের সাথে কথা বলুন। সুস্থায়ী উন্নয়ন এবং দীর্ঘমেয়াদী বন্দোবস্তের এই উদাহরণ ছড়িয়ে পড়ুক বাংলার প্রতিটি অঞ্চলে।