সাক্ষাৎকার

পরিবেশ সংক্রান্ত সাংবাদিকতার হাল হকিকত : সাক্ষাৎকারে জয়ন্ত বাসু

পরিবেশ সংক্রান্ত সাংবাদিকতার হাল হকিকত : সাক্ষাৎকারে জয়ন্ত বাসু

জয়ন্ত বাসু কুড়ি বছরেরও বেশি সময় ধরে পরিবেশ এবং জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে সাংবাদিকতা করছেন। তিনি টেলিগ্রাফের হয়ে একাধিক পরিবেশ সংক্রান্ত ক্যাম্পেইন সাফল্যের সাথে পরিচালনা করেছেন। সাংবাদিকতা ছাড়াও তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ফ্যাকাল্টি ও বটে।

সবুজ পৃথিবী : পরিবেশ নিয়ে সাংবাদিকতা করতে গিয়ে কি কখনো সেন্সরশিপের মুখোমুখি হতে হয়েছে? সেটা আপনার কাগজের দপ্তর থেকেও হতে পারে আবার কোন পলিটিক্যাল পার্টি থেকে?

জয়ন্ত বাসু: খুব সামান্য বিক্ষিপ্ত কিছু ঘটনা ছাড়া এরকম কিছু আমার সাথে হয় নি। এখানে একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হল, প্রতিটি সংবাদপত্রেরই একটা নিজস্ব চিন্তা ধারা রয়েছে, একটা নিজস্ব পলিসি রয়েছে। এটা মেনস্ট্রিম মিডিয়া! আমার নিজস্ব কাগজ নয়। পরিবেশ সংক্রান্ত খবর মূলত দুই প্রকার। এক, ঘটনা ভিত্তিক মানে যেমন একটা পুকুর বোজানো হচ্ছে বা একটা গাছ কাটা হয়েছে। দুই, অ্যানালাইসিস ভিত্তিক যেখানে আপনি বড় ছবি বা বিগ পিকচারকে মাথায় রেখে করা। যেখানে পলিটিক্স পরিবেশ মিলে মিশে এক হয়ে যায়। সেই জায়গায় কিন্তু সাংবাদিকের চিন্তা ভাবনা, তার পড়াশুনো এই গুলোর পরীক্ষা। সেন্সরশিপের ঘটনা যে ঘটেনি আমি তা বলবো না, কিন্তু আমার সাথে এই ধরনের কিছু হয়নি এটা আমি বলতে পারি।

সবুজ পৃথিবী: পশ্চিমবঙ্গের পরিবেশ সংক্রান্ত সাংবাদিকতা সেটা কি যথেষ্ট পরিমাণে হয় এবং সেটার বর্তমান পরিস্থিতি কিরকম?

জয়ন্ত বাসু: এখানে একটা জিনিষ বোঝার আছে সেটা হল পরিবেশ সংক্রান্ত যে সাংবাদিকতা সেটা কিন্তু অপেক্ষাকৃতভাবে নবীন। মানে ১৯৬২ সালে রেচেল কারসন এর সাইলেন্ট স্প্রিং দিয়ে পরিবেশ সাংবাদিকতার ভিত্তিপ্রস্থর কিন্তু স্থাপিত হয়। কাজেই ক্রাইম বা পলিটিক্স এর তুলনায় পরিবেশ কিন্তু খানিকটা দেরি করেই শুরু করেছে। তারপর ইরাক ইরান যুদ্ধের ফলে তেলের খনিগুলি থেকে বেরোনো দূষণ এবং সেই সামুদ্রিক পাখির ছবি যে ডানায় তেল লাগার কারণে উড়তে পাড়ছে না। তারপরে আইপিসিসি রিপোর্ট বেরোনোর সাথে সাথে পরিবেশ আস্তে আস্তে আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়ল। যদি বাংলার কথা বলি আমি সেক্ষেত্রে আমি প্রায় কুড়ি বছর ধরে পরিবেশ সাংবাদিকতা করছি এবং বর্তমানে পরিবেশ সাংবাদিকতা বাংলাতে কিন্তু অনেকটাই উন্নতি করেছে। যদিও সংখ্যাগত দিক থেকে পরিবেশ নিয়ে লেখালেখি মেইনস্ট্রিম মিডিয়াতে বাড়লেও অ্যানালিটিক্যাল রিপোর্ট কিন্তু আমি বাংলায় খুব বেশি দেখিনি। সেই জায়গায় কিন্তু একটা ঘাটতি আছে বলে আমার মনে হয়।

সবুজ পৃথিবী: একটা ক্রাইম বা পলিটিক্যাল জার্নালিস্টের সাথে একটা এনভারমেন্টাল জার্নালিস্ট এর পার্থক্যটা কোথায়?

জয়ন্ত বাসু: যখন একটা এনভারমেন্টাল জার্নালিস্ট স্টোরি করেন বা একটা অ্যানালিসিস করেন, তখন তাকে পরিবেশ ছাড়াও সমাজ, অর্থনীতি এবং রাজনীতি এই তিনটের সম্পর্কেই অবহিত হতে হয়। কারণ পরিবেশ কিন্তু সাংঘাতিক ভাবে এই তিনটের সাথে জড়িত। আর যেহেতু এটা একটা বিজ্ঞানভিত্তিক বিষয় কাজেই, পরিবেশ নিয়ে লেখালেখি করতে গেলে, আপনার বিজ্ঞানমনস্কতার সাথে সাথে সমসাময়িক বৈজ্ঞানিকদের কাজ সম্পর্কে একটা পরিস্কার ধারনা থাকতে হবে।

সবুজ পৃথিবী: পশ্চিমবঙ্গের পরিবেশ সাংবাদিকতার সমস্যা গুলো কি কি?

জয়ন্ত বাসু: এইটা একটা উদাহরণ দিলে হয়তো একটু বেশি ভালো বোঝা যায়। অনেকসময়ই দেখতে পাবে যে কলকাতা বায়ু দূষণের পরিমাণ দিল্লি থেকেও বেশি হয়ে গেছে। এরকম একটা খবর প্রকাশ করার লোভ হয়তো সবাই ছাড়তে পারে না। কিন্তু এরকম একটা খবর প্রকাশ করার আগে এটা দেখা উচিৎ, যে সময়ের কথা বলা হচ্ছে সেই সময় কলকাতা এবং দিল্লির বায়ুদূষণ কে আমরা তুলনা করতে পারি কিনা? কিছু বছর আগেই এটা হয়েছিল যে সময় সদ্য বৃষ্টি হওয়ায় দিল্লির বায়ুদূষণ খানিকটা কমে গিয়েছিল এবং সেইসময় কলকাতার বায়ু দূষণের সাথে তুলনা করে দেখা গেছে যে কলকাতার বায়ুদূষণ অনেক বেশি দিল্লির থেকে। কাজেই এই সংক্রান্ত কোন খবর লেখার আগে একটা পড়াশোনা করার খুবই দরকার আছে। আরেকটা ব্যপার যেটা আমার মনে হয়েছে যে কলকাতাতে পরিবেশ নিয়ে যারা সাংবাদিকতা করেন তাদের কিছু ধরাবাঁধা বিশেষজ্ঞ আছে এবং তারা পরিবেশ সংক্রান্ত যে কোনো খবরেই সেই বিশেষজ্ঞদের কোটেশন গুঁজে দেন। সেই বিষয়ে দেশের অন্যান্য বৈজ্ঞানিক বা আন্তর্জাতিক বৈজ্ঞানিকদের সাথে কথা বলার কথা ভাবাই হয়না। সবাই সব কিছু জানতে পারে না! সাংবাদিকদের just another story! এই ধারণাটা পরিবেশ নিয়ে প্রতিবেদনগুলোকে খেলো করে দেয়।

সবুজ পৃথিবী: জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে সরকার কতটা সচেতন হয়েছে?

জয়ন্ত বাসু: জলবায়ু পরিবর্তন একটা বিশাল বড় বিষয়। সেখানে সোলার আছে, এক্সট্রিম ইভেন্ট আছে, বন্যা খরা আছে। সরকার কিন্তু ঘটনা সম্পর্কিত কাজ করে। মানে ধরো এই যে আম্ফান হলো, সরকার কিন্তু ফাটিয়ে কাজ করেছে কিন্তু এটা তাদের অজানা যে আম্ফান কিন্তু একটা জলবায়ু পরিবর্তনের ফল। আমার অভিজ্ঞতা থেকে আমি বলতে পারি যে অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে যারা আছেন তারা কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে খুব একটা সচেতন নয়। একটা রাজনৈতিক যিনি মাঠে ঘাটে ঘুরে কাজ করেন তিনি কিন্তু জানেন যে ফসল কম হচ্ছে বা মাছ মরছে। তিনি হয়তো এটা জানেন না যে এটা জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে হচ্ছে, কিন্তু ঘটনাটা সম্পর্কে তার কিন্তু ধারণা আছে। কিন্তু যারা সরকারের পলিসি বা decision-making এর উচ্চ পর্যায়ে বসে আছেন তারা কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে মোটেও ভাবছেন না। তাদের অফিসের বাইরে কি ঘটছে সেটা নিয়ে তিনি ওয়াকিবহাল নন।

সবুজ পৃথিবী: জলবায়ু পরিবর্তন তো একটা দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। সেটা কি পলিটিকাল লিডারদের কাছে খুব একটা পাত্তা পায় কারণ তাঁদের তো পাঁচ বছর করে করে ভাবতে হয়?

জয়ন্ত বাসু: পরিবেশের বিরুদ্ধে কাজ করার একটা ভালো বাজার আছে। পরিবেশের বিরুদ্ধে কাজ করে খুব অল্প সময়ে কিন্তু তুমি প্রচুর কিছু কামিয়ে নিতে পার। সেটা কয়লা খাদান হতে পারে আবার জঙ্গল কেটে রিসর্ট হতে পারে। এটা জলবায়ু পরিবর্তনের একটা সমস্যা বটে যে long-term প্রেডিকশন যেগুলো আছে সেগুলো ২০৫০ বা ২০৭০ এই সালগুলোর কথা বলে। পলিটিক্যাল নেতাদের পক্ষে ওতো দিনের কথা ভাবাটা একটু শক্ত সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তারা পাঁচ বছরের বেশি কিন্তু কখনোই ভাববেন না।

সবুজ পৃথিবী: সোশ্যাল মিডিয়ায় এসে যাওয়া একটি পরিবেশ নিয়ে লেখালিখি খানিকটা বেড়ে গেছে? এইটা সম্পর্কে আপনার কি মতামত?

জয়ন্ত বাসু: এটা একদিক থেকে ভালো। কারণ গুচ্ছ গুচ্ছ পরিবেশ নিয়ে লেখা বেরোচ্ছে সেটা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। নাম্বারটা ম্যাটার করে কিছু কিছু সময়। কিন্তু একইভাবে কোয়ালিটি কিন্তু কম্প্রোমাইজ হচ্ছে। মানে আমি এরকম একাধিক ঘটনা দেখেছি যেখানে পরিবেশ পরিবর্তনের কোন একটা বিষয় নিয়ে একেবারেই অজ্ঞ কেউ একজন ওপেন ফোরামে বিশেষজ্ঞের মত কথা বলেছেন।

সবুজ পৃথিবী: নতুন কি পড়ছেন? কি লিখছেন বা নতুন স্টোরি কি কি আসতে চলেছে?

জয়ন্ত বাসু: বই পড়তে আমার খুবই ভালো লাগে। সুচিত্রা ভটাচার্য থেকে ipcc রিপোর্ট সবই পড়ি। ডিটেকটিভ গল্প খুব পছন্দের। Springer থেকে একটা বই বেরোচ্ছে যেখানে আমি ভারত বাংলাদেশ ট্রানসবাউন্ডারী নদী নিয়ে লিখছি। আর একটি দক্ষিণ ভারতীয় সর্বাধিক প্রচারিত মালায়ালাম মনোরমার বাংলা একটা বাৎসরিক রিপোর্ট বেরোয়, তাতে “রুটি কাপড়া মকান আর পরিবেশ” নামের একটা প্রবন্ধ লিখছি। আর সাথে সাথে পড়ানো এবং সম্পাদকীয় লেখা তো আছেই।

Leave a Comment