সাক্ষাৎকার

সাক্ষাৎকারে কোলকাতার বাইসাইকেল মেয়র শতঞ্জীব গুপ্ত

সাক্ষাৎকারে কোলকাতার সাইকেল মেয়র শতঞ্জীব গূপ্ত

জলবায়ু পরিবর্তন বা বিশ্বউষ্ণায়ন, পৃথিবী জুড়ে ঘটে চলা একটি বিষয় কিন্তু তাবলে আমাদের ব্যাক্তিগত প্রয়াস যে এখানে কাজে লাগবে না তা কিন্তু নয়। সাম্প্রতিককালে ইন্সিটিউট ফর ট্রান্সপোর্ট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টাল পলিসি এর রিসার্চ এর গবেষণা অনুযায়ী শহরে সাইকেল চালকদের সংখ্যা মাত্র ২০% বাড়লে পরিবহন ক্ষেত্রে ১১% কার্বন ডাই অক্সাইড কমে যাবে। কোভিড পরবর্তী পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশে সাইকেল চালকদের সংখ্যা নিঃসন্দেহে বেড়েছে। এই সময়ে দাড়িয়ে আমরা কথা বলব শতঞ্জীব গুপ্তের সাথে যিনি কলকাতা শহরের ‘বাইসাইকেল মেয়র’ এবং শহরে সাইকেল চালানো নিয়ে কাজ করে চলেছেন।

সবুজ পৃথিবীঃ   পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশে সাইকেল চালক এবং তাদের কোভিড পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী অবস্থায় কি পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে?

শতঞ্জীবঃ    সাইকেল সম্পর্কে সাধারণ ধারণা হোলো – “এটা নিম্নবিত্তদের বাহন ও দারিদ্র্যের চিহ্ন“। কিছু ব্যাতিক্রম ছাড়া, বেশির ভাগ মানুষের মধ্যে একধরণের সাইকেল-বিমুখতা কাজ করতো এই দুই দেশে, বিশেষ করে বড় শহরগুলোয়। আমরা সব সময়ই নিজের  অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতির সাথে সাথে, সাইকেল থেকে বাইক, বাইক থেকে গাড়ির কথা আগে ভাবি। কাজেই পরিবেশের জন্যে সাইকেল চালানো ভালো, বা যদি সাইকেল চালানোর উপায় থাকে আমি সাইকেলই যাবো, এই মানসিকতা সত্যি কথা বলতে আগে ছিল না মানুষের। কোভিড পরবর্তী সময়ে মানুষ অনেকটাই এই মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছে এবং ফলস্বরূপ সাইকেলের সংখ্যা চোখে পড়ার মত বেড়ে গেছে। আনলক পর্বের শুরুর দিকে গণপরিবহন এড়িয়ে, শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার জন্য দলে দলে মানুষ সাইকেল বেছে নিচ্ছিলেন। সাথে সাথে এটাও বলব, কোভিডের সময় বা পরবর্তী সময় সাধারন মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থাও খানিকটা খারাপ যাচ্ছে এবং যার ফলে অনেকেই যাতায়াতের ভাড়া বাঁচাবার জন্যে সাইকেলের ওপর ভরসা রাখছেন। অনেকে আবার নতুন করে সাইকেল চালানোর আনন্দের দিকটাও নতুন করে আবিষ্কার করেছেন এই সুযোগে। গত ছয়-সাত মাসে মোটামুটি একই চিত্র লক্ষ্য করা গেছে কলকাতা, ঢাকা এবং জেলা সদর গুলিতে।

সবুজ পৃথিবীঃ    একটা প্রশ্ন চলেই আসে যে সাইকেল কি রাস্তার গতিকে ধীর করে দিচ্ছে?

শতঞ্জীবঃ    প্রথমত প্রশ্ন আসবে, রাস্তায় কার গতি ধীর হয়ে যাচ্ছে সাইকেলের ফলে? পঞ্চাশ জন সাইকেল আরোহী যদি পাঁচটি প্রাইভেট গাড়ির গতি কমিয়ে দেন, যাতে সফর করছেন মাত্র পাঁচজন মানুষ – সেক্ষেত্রে আমি কাকে প্রায়োরিটি দেবো? পাঁচজনকে? নাকি পঞ্চাশজনকে? দ্বিতীয়ত, সাইকেলের জন্য গাড়ির গতি ধীর হয় – এটা একটা ভুল ধারণা। সেইসঙ্গে এটা একটা Car-centric দৃষ্টিভঙ্গিও বটে। ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত গাড়ি মোটর-ট্রাফিকের গড় গতি কমায়। তৃতীয়ত, সাইকেলের জন্য পৃথক লেন আলাদা করে দিলেই এইসব সমস্যার সমাধান সম্ভব। এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক, আমাদের দেশে পরিবহন-ব্যবস্থায় মানুষের যাতায়াতকে গুরুত্ব দেওয়া হয় না। গুরুত্ব দেওয়া হয় গাড়ির যাতায়াতকে। শুধু সাইকেল নয়, অতিরিক্ত প্রাইভেট গাড়িকে প্রাধান্য দেওয়া তো উন্নত গণপরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তোলার পক্ষেও প্রতিকূল। কলকাতায় মানুষের গড় যাতায়াতের দূরত্ব ৩-৫ কিলোমিটার। বোঝাই যাচ্ছে এই অল্প দূরত্ব যদি মানুষকে সহজভাবে সাইকেল করে যাতায়াত করতে দেওয়া হয় তা পরিবেশ এবং মানুষের পকেট বান্ধব। যাঁরা প্রাইভেট গাড়ি ব্যবহার করেন, বাইসাইকেল-কালচার গড়ে তোলা গেলে তাঁরাও অনেকে ছোটো দূরত্বগুলিতে সাইকেল বেছে নেবেন বলে আমাদের বিশ্বাস। সাইকেল-পরিকাঠামো তৈরি করা গেলে আসলে শহরে স্বাচ্ছন্দ্য আসবে। গতিও বাড়বে অন্যান্য যানবাহনের।

 

সবুজ পৃথিবীঃ   “তৃতীয় বিশ্বের শহরে সাইকেল বান্ধব রাস্তা- এটা কি সোনার পাথর বাটি নয়?”

শতঞ্জীবঃ   প্রথম বিশ্বের নেদারল্যান্ডস বা ইউরোপের বাকি দেশগুলির কথা বাদই দিলাম, কলোম্বিয়ার রাজধানী বোগোটা এটা করে দেখিয়েছে। আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ যেমন উগান্ডা, ইথিওপিয়া কিম্বা নাইজেরিয়ার সরকার রাস্তাকে সাইকেল বান্ধব করে তোলার জন্যে উঠে পড়ে লেগেছে, বিশেষ করে কোভিডের পর। রাস্তাকে সাইকেল বান্ধব করতে অতি সামান্য খরচ লাগবে। সব থেকে বড় ব্যাপার কোভিড পরবর্তী সময়ে সাধারন মানুষের সাইকেল নির্ভর মানসিকতার এই বড় পরিবর্তনকে এখনই কাজে লাগানো উচিত প্রশাসনিক দিক থেকে।

সবুজ পৃথিবীঃ   কলকাতায় বেশ কিছু দিন আগে বেসরকারি এক অ্যাপ ঘণ্টা হিসেবে সাইকেল ভাড়া দিতে শুরু করলেও কিছু দিনের মধ্যে তা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়। এটা কেন বলে মনে হয়?

শতঞ্জীবঃ  ‘পাবলিক বাইসাইকেল শেয়ারিং’-এর জন্য কলকাতা আগে তেমন প্রস্তুত ছিল না। নানা রাস্তায় সাইকেল নিষেধাজ্ঞা ও যথাযথ পরিকাঠামোর অভাব –  সব মিলেমিশে এটা হয়ত চলে নি কলকাতায়।  কিন্তু কিছুদিন আগেই নিউটাউনে আবার শুরু হয়েছে সাইকেল ভাড়া নেওয়ার অ্যাপ। কোভিড পরবর্তী সময়ে যেভাবে মানুষ সাইকেল চড়ছেন তাতে এই বারে কিন্তু আমি আশাবাদী যে এটা চলার সম্ভাবনা প্রবল।

সবুজ পৃথিবীঃ    কলকাতাতে মেট্রো বা ট্রেন বা বাসে সাইকেল নিয়ে মানুষ উঠছে এই ছবি দেখা যেতে পারে?

শতঞ্জীবঃ    কেন নয়? একটু পরিকল্পনা থাকলেই সম্ভব। চেন্নাই বা ব্যাঙ্গালোর মেট্রোরেলে কিন্তু পরীক্ষামুলক ভাবে এটা শুরু হয়েছিল। সম্প্রতি নাগপুর ও কোচি মেট্রোও কিছু স্টেশন থেকে  সাইকেল নিয়ে সরাসরি কামরায় উঠতে দেওয়ায় উৎসাহ দিচ্ছে। কলকাতার মেট্রো কিম্বা শহরতলীর ট্রেনেও এই ব্যবস্থা শুরু করা অসম্ভব নয়। যেমন মাতৃভূমি লোকালের মত ট্রেন চলে, শুধু মেয়েদের জন্য, –  তেমনই যদি একটা বা দুটো, ট্রেন বা মেট্রো প্রত্যেক রুটে চালানো যায়, নির্দিষ্ট সময়ে, যাতে সাইকেল আরোহীরাও উঠতে পারবেন, তা হলেই মিটে যায়। তার আগে অবশ্য গোটা কলকাতায় অবাধে ও নিরাপদে সাইকেল চালানোটা নিশ্চিত করতে হবে। পরিবহন ব্যবস্থায় সাইকেলকে গুরুত্ব দিতে হবে। সদিচ্ছা থাকাটা খুব জরুরি। বাংলার বিভিন্ন জেলা শহরেও কিন্তু মোটর গাড়ির সংখ্যা ও দাপট যেভাবে বাড়ছে, সেখানেও ক্রমশ সাইকেল কোণঠাসা হয়ে পড়বে। প্রতিরোধটা কিন্তু এখন থেকেই শুরু হওয়া দরকার। আমাদের বুঝতে হবে, শুধুমাত্র পরিবেশের জন্য নয়, সাইক্লিং একটি অত্যন্ত স্বাস্থ্যকর অভ্যাস। নিয়মিত সাইকেল চালালে ডায়াবেটিস, আর্থ্রারাইটিস ইত্যাদি আরো অসংখ্য রোগ থেকে দূরে থাকা যায়। এমনকি মানসিক স্বাস্থ্যের উপরেও সাইকেল চালানোর সদর্থক প্রভাব পড়ে। স্বতস্ফূর্ত ও আন্তরিক একটা প্রতিরোধ তো এই জায়গা থেকেই শুরু হতে পারে।

সবুজ পৃথিবীঃ    ‘কলকাতা সাইকেল সমাজ’ ও ‘BYCS’- যে দুটি সংগঠনের সাথে আপনি জড়িত, সেগুলো নিয়ে কিছু বলুন। ভবিষ্যতে কি ভাবছেন আপনারা এবং কেউ যদি আপনাদের সাথে যোগাযোগ করতে চা্ন কি ভাবে করবে?

শতঞ্জীবঃ   প্রায় ১১/১২ বছর আগে ‘কলকাতা সাইকেল সমাজ’ শুরু হয়েছিল শহরে সাইকেল-ফাইন ও সাইকেল-নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে, একটা অধিকার আন্দোলনের জায়গা থেকে। ক্রমশ তার সঙ্গে জুড়ে গেল শহরের সামগ্রিক পরিবেশ ও সাইকেলকে ঘিরে ভবিষ্যৎ শহরের প্রসঙ্গগুলো। ‘কলকাতা সাইকেল সমাজ’-এর কাজকর্মের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে BYCS-এর আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক সম্পর্কে খোঁজ পাই। বর্তমানে ভারতের ৪৫ টি শহর মিলিয়ে পৃথিবীর ১০০ টিরও বেশি শহরে শুরু হয়েছে ‘বাইসাইকেল মেয়র প্রোগ্রাম’। BYCS–এর  স্লোগান– “50 by 30” – অর্থাৎ ২০৩০ সালের মধ্যে পৃথিবীর শহরগুলোর মোট যাতায়াতের অর্ধেক বা পঞ্চাশ শতাংশ হোক সাইকেলে। BYCS বিশ্বাস করে সাইকেলকে গুরুত্ব দিলে বদলাবে আমাদের শহরগুলো এবং শহর বদলালে – বদলাবে পৃথিবী। শহরে সাইকেলের পক্ষে জনমত তৈরি করার পাশাপাশি, সাইকেলের পক্ষে প্রশাসনিক পদক্ষেপ ও প্রকল্পগুলোর সঙ্গেও নিয়মিত যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করছেন বিভিন্ন শহরের বাইসাইকেল মেয়ররা। আর আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখুন বিভিন্ন স্যোশাল মিডিয়ায় বা সরাসরি।

সবুজ পৃথিবীঃ    শেষ প্রশ্ন, জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে বাংলায় সম্ভবত প্রথম ব্লগ সবুজ পৃথিবী। সবুজ পৃথিবীর জন্যে আপনার কি বার্তা?

শতঞ্জীবঃ   সাইকেল কিভাবে পরিবেশের উপর প্রভাব ফেলতে পারে এই প্রসঙ্গে রাষ্ট্রপুঞ্জের একটি রিপোর্টের উল্লেখ করবো। ঐ রিপোর্ট অনুযায়ী, নেদারল্যান্ডসের মানুষ গাড়ি বাদ দিয়ে যে পরিমাণ সাইকেল চালান ও তার ফলে যে পরিমাণ কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গমন কম হয়, তা কোনো একটি বছরে সাড়ে পাঁচ কোটি বৃক্ষরোপনের সমতুল্য।

অর্থাৎ আমি বলতে চাই – আজকের দুনিয়ায়, কলকাতা শহরে দাঁড়িয়ে – শুধুমাত্র সাইকেল চালানোটাই হয়তো একটা ‘অ্যাক্টিভিজম’। নিজের সুবিধা, নিজের সাশ্রয়, নিজের স্বাস্থ্য বা শুধুমাত্র নিজের ভালোলাগার জায়গা থেকেই শহরের ছোটো দুরত্বগুলিতে সাইকেল চালানো শুরু করে দিন। পৃথিবীটাও হয়তো ঘুরে দাঁড়াবে ঐ মুহূর্ত থেকেই।

Leave a Comment