কলমেঃ দেবদীপ ঘোষাল
লেখক পরিচিতিঃ
দেবদীপ ঘোষাল ইউনিভার্সিটি অফ বাসেল, সুইজারল্যান্ড এ পদার্থবিদ্যা নিয়ে গবেষণা করেন। গবেষণার বাইরে তিনি পরিবেশ এবং জলবায়ু নিয়ে সচেতনতা কর্মসূচির যুক্ত।
—————————————————————————————————————–
শীতের সময় ঝড়–বৃষ্টি যখন আমাদের ভ্রমণ-পরিকল্পনাগুলোকে ও দৈনন্দিন জীবনকে বিপজ্জনক করার হুমকি দেয়, তখন শীতপ্রধান অঞ্চল ও দেশের লোকেরা প্রায়ই নুন নিয়ে হাইওয়ে, রাস্তা এবং ফুটপাতের উপর তুষার এবং বরফ গলানোর জন্য ছড়িয়ে দেয়। নুন ‘রোড–সেফটি’ তথা সুরক্ষার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সরঞ্জাম, কারণ প্রতি বছর সারা পৃথিবীতে আবহাওয়া সম্পর্কিত দুর্ঘটনার কারণে কয়েক হাজার মানুষ মারা যান বা আহত হন। তবে মেরিল্যান্ড ইউনিভার্সিটির সুজয় কৌশলের নেতৃত্বে করা একটি নতুন গবেষণায় অশনি সংকেত দেওয়া হয়েছে যে পরিবেশে নুনের আধিক্য যেমন– রাস্তা ডি–আইসিং করা, কৃষিজমি বা অন্য উদ্দেশ্যে সার নির্ধারণ করা আদতে বিষাক্ত রাসায়নিক ককটেল তৈরী করে যা বিশেষত মিষ্টি জল এবং আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক এক বিশ্বব্যাপী ক্রমবর্ধমান সমস্যা।
গবেষণায় দেখা গেছে যে পরিবেশে যুক্ত হওয়া লবণ মাটির সাথে মিশে গিয়ে ধাতব–ককটেল তৈরী করে, যাতে এমনকি তেজস্ক্রিয় কণাও দ্রবীভূত হয়ে যেতে পারে। কৌশলদের গ্রুপ এই ক্যাসকেডিং এফেক্টগুলোর নাম দিয়েছে “ফ্রেশওয়াটার স্যালিনাইজেশন সিনড্রোম”, যেটা পানীয় জল বিষাক্ত করে দেয় এবং মানুষের স্বাস্থ্য, কৃষি, পরিবেশ–পরিকাঠামো, বন্যপ্রাণী এবং বাস্তুতন্ত্রের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
স্যালিনাইজেশন সিনড্রোমের একটি ধারণামূলক মডেল
“ফ্রেশওয়াটার স্যালিনাইজেশন সিনড্রোম”–র কারণে সৃষ্ট জটিল সমস্যাগুলোর মানব স্বাস্থ্যের উপর প্রভাব কৌশলের নতুন গবেষণাপত্রটিই প্রথম বিশ্লেষণ করে দেখাতে পেরেছে। এই অ্যানালিসিস কাজটা বলছে – যদি নুনের উত্সগুলির নিয়ন্ত্রণ না করা যায় এবং সঠিক ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, তবে বিশ্বে স্বাদু জলের সরবরাহ স্থানীয়, আঞ্চলিক এবং সমগ্র আন্তর্জাতিক স্তরে গুরুতর সমস্যার সম্মুখীন হতে পারে। অ্যাসিড বৃষ্টিপাত, জীববৈচিত্র্য–হ্রাস এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পরিবেশগত সমস্যার সঙ্গে নুনের ব্যবহার কমানোর এই সমীক্ষাটিও একই উদ্বেগের সাথে, ২০২১ সালের এপ্রিল মাসে একটি আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।
মেরিল্যান্ড–র ভূতত্ত্ব ও আর্থ সিস্টেম বিভাগের অধ্যাপক কৌশলের বক্তব্য: আমরা এতদিন এই নুন ব্যবহার করাটাকে এতটা কোনও সমস্যার বলে ভাবিনি; মানুষ ভাবতো যে এটা শীতকালে তুষারপাতের সময় রাস্তায় ছড়ানো হয় আর কিছু সময় পরে বরফ গলে গেলে সেই নুনও ধুয়ে যায়। তবে দেরিতে হলেও বুঝতে পারা গেছে যে, এটি চারপাশে আদতে আটকে পরে জমা থেকে যাচ্ছে। এখন এর ফলস্বরূপ আমরা তাৎক্ষণিক আর দীর্ঘস্থায়ী দুরকমের ঝুঁকিপূর্ণ সমস্যারই সম্মুখীন হচ্ছি, যেটা কিনা পরিবেশ আর পরিকাঠামোগত বিপদ আরো বাড়িয়ে তুলছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে নুনের আধিক্যের ফলে এই মিষ্টি জলের সমস্যা কিন্তু রাশিয়া, কানাডা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা উত্তর ইউরোপে সীমাবদ্ধ নেই, বরং গোটা বিশ্বব্যাপীই কম বেশি দেখা যাচ্ছে।
কৌশলের টিম বিশ্বব্যাপী মিষ্টি জলের মনিটরিং স্টেশনগুলির ডেটা তুলনা করে পর্যালোচনা করতে গিয়ে– বিশ্বব্যাপী ক্লোরাইডের ঘনত্ব–বৃদ্ধি লক্ষ্য করেছে। ক্লোরাইড হল একটা খুব সাধারণ উপাদান যেটা বিভিন্ন সল্ট–এই থাকে যেমন– সোডিয়াম ক্লোরাইড (table salt) এবং ক্যালসিয়াম ক্লোরাইড (সাধারণত ‘road-salt’ হিসেবে ব্যবহৃত)। কিছু বিশেষ অঞ্চলের ডেটা বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে যে– গত ৩০ বছর ধরে সেইসব জায়গার পরিবেশে (বিশেষ করে শীতপ্রধান অঞ্চলে) মাইলের পর মাইল জুড়ে ইতিমধ্যে স্যালিনিটি বেড়ে চলেছে।
এই অঞ্চলে মানুষের সাথে সম্পর্কিত নুনের সবচেয়ে বড় উত্স হ‘ল রাস্তার জন্য ব্যবহৃত রোড সল্ট, তবে তার সাথে অন্যান্য উত্সগুলির মধ্যে রয়েছে নিকাশী লিক এবং ডিসচার্জ, ওয়াটার–সফটনার, কৃষি সার ইত্যাদি। এছাড়াও, মিষ্টি জলে লবণের পরোক্ষ উত্সগুলির মধ্যে রাস্তা, সেতু এবং ঘর–বাড়িকে আবহাওয়ার উপযুক্তকরন ব্যাপারটা রয়েছে, যাতে প্রায়ই চুনাপাথর, কংক্রিট বা জিপসাম থাকে; আর এগুলির সমস্তই ভেঙে গিয়ে নুনের বাড়তি পরিমানের জন্ম দেয়। অ্যামোনিয়াম–ভিত্তিক সারগুলিও আবার কৃষিক্ষেত্রে এবং শহুরে জমিতে নুনের পরিমান বাড়িয়ে দিয়ে থাকে। কিছু উপকূলীয় পরিবেশে সমুদ্রস্তরের বৃদ্ধি (sea level rising) নোনা জলের প্রবেশের আরও একটি উৎস হয়ে উঠছে।
বিশ্বের নানান প্রান্তের গবেষণায় উঠে এসেছে যে কিভাবে এইসব নুনের উৎস থেকে নির্গত কেমিক্যাল ককটেল পরিবেশের ক্ষতি করছে, উদাহরণস্বরূপ বলা যায়– মাটিতে নুনের মাত্রা–বৃদ্ধি জন্ম দিচ্ছে এমন কিছু প্রজাতির যারা অপেক্ষাকৃত বেশি আক্রমণাত্মক এবং অধিক মাত্রায় নুনের প্রতি সহনশীল; এছাড়া স্যালিনেশন জল এবং মাটিতে মাইক্রোবদের পরিবর্তনও ঘটিয়ে ফেলছে। মাইক্রোবরা বাস্তুতন্ত্রের পুষ্টিগত ভারসাম্য রক্ষায় অপরিহার্য, ফলে তাদের পরিবর্তন মানে হল সমগ্র বাস্তুতন্ত্রেরই আদতে বিপদ ডেকে আনা।
অন্যদিকে নুনের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার রাস্তাঘাট এবং পরিকাঠামোরও ক্ষতি করে। জলের পাইপে ক্ষয় ধরিয়ে দিয়ে ভারী বিষাক্ত ধাতুকনা পানীয় জলে মেশার রিপোর্টও সম্প্রতি এসেছে বেশ কিছু জায়গায়। কানেক্টিকাট বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডঃ জিন ই লিকেন্স–এর বিস্মিত উক্তি– “ভূগর্ভস্থ জলে ক্রমবর্ধমান এই স্যালাইনাইজেশন বিশ্বের অনেক জায়গায় একটি বড় পরিবেশগত সমস্যা হয়ে উঠছে, যদিও অনেকেই এই বিষয়ে ভালোভাবে এখনো অবগতই নন!”
নুনের বিভিন্ন উৎস এবং পরিবেশের সঙ্গে তাদের ইন্টারঅ্যাকশন বিশদভাবে এখনো আমাদের কাছে পরিষ্কার নয়, আর তার সঙ্গে এক এক ওয়াটারবডির (lakes, streams, aquifers etc.) এক একরকম ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম সেই কাজটিকে আরো কঠিন করে তোলে। বিজ্ঞানীদের আশা আগামী দিনে উন্নত প্রযুক্তি এবং নতুন নতুন সমন্বিত ম্যানেজমেন্ট পন্থাগুলো ‘ফ্রেশওয়াটার স্যালিনাইজেশন সিনড্রোম’–এর এই সম্ভাব্য ঝুঁকিকে হ্রাস করতে সক্ষম হবে।
শেষ পর্যন্ত আমাদের আরো ওপর মহলে নিয়ন্ত্রণ দরকার, কিন্তু দুর্ভাগ্যের ব্যাপার হলো আমাদের এখনও স্থানীয় এখতিয়ার, বিচারব্যবস্থা এবং জল–সরবরাহের পর্যাপ্ত সুরক্ষা নেই। আমরা মানবজাতি, ইতোমধ্যেই অ্যাসিড রেন, বায়ু দূষণ ইত্যাদি কমানোতে বেশ কিছুটা সাফল্য পেয়েছি, সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তন (climate change) নিয়েও সমানভাবে সচেতনতা বৃদ্ধির ও মোকাবিলার চেষ্টা চলছে। কৌশলদের মতো বিজ্ঞানীদের মতে এই জায়গায় আমাদের সবার উপলব্ধি করার দরকার হল– পরিবেশে যুক্ত হওয়া বাড়তি নুনের ক্ষতিকর প্রভাব ও বিষক্রিয়া আর তার সঠিক নিয়ন্ত্রণ। একমাত্র এভাবেই আমরা অদূর ভবিষ্যতের পরিস্রুত জল সরবরাহের ঘাটতির বিপদটাকে এড়াতে সক্ষম হব।
বর্তমান গবেষণাগুলো জলের সঠিক পরীক্ষা–নিরীক্ষণ এবং আধুনিক সেন্সর প্রযুক্তি ব্যবহারের সাহায্যে অনবরত ডেটা কালেকশন–এর ওপর ভীষণভাবে জোর দিচ্ছে। উচ্চ–ফ্রিকোয়েন্সি সেন্সর ডেটা বিজ্ঞানীদের এবং ম্যানেজারদের লবণাক্ততা (salinity) এবং জলের প্রবাহের (water flow) পিক পজিশন শনাক্তকরণে সুবিধে করে দেয় যা শেষ পর্যন্ত তাদের ‘ফ্রেশওয়াটার স্যালিনাইজেশন সিনড্রোমের’ কারণে সৃষ্ট রাসায়নিক সংমিশ্রণ (chemical composition) এবং বিষক্রিয়া সম্পর্কে পূর্বাভাস দিতে সহায়তা করতে পারে।
এছাড়াও, বিজ্ঞানীদের অনুমান– পরিবেশে লবণের দ্রুত–বর্ধমান প্রভাবগুলোর সন্ধান করে এমন ফিল্ড–স্টাডি এবং পরীক্ষাসমূহ এই সমস্যাটার বিজ্ঞান–ভিত্তিক উপলব্ধিকে আরও ত্বরান্বিত করবে। কৌশল নিজে সহযোগীদের নিয়ে তাঁর ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসের কাছাকাছি বয়ে চলা প্রবাহগুলিতে (streams) এই জাতীয় গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন, আর এমন সার্ভে ও গবেষণার উদাহরণ এশিয়া বা ইউরোপেও ইদানিংকালে মিলছে।